অমরনাথ যাত্রা
পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে হিমালয়কে শেষ ছুঁয়েছিলাম ২০১২সালে। তারপর থেকেই অবস্থাটা ‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক, মুদিয়া নয়নে…’।নয়ন মুদিয়া না হয় কিছুকাল থাকা যায়। কিন্তু চিত্তের ছটপটানি!তাকে যে খোলস ছাড়তে হিমালয়ের পথে যেতেই হবে নইলে উৎসাহ আসে না কর্মে। সেই কিশোর বয়সে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হিমালয় ভ্রমণ’ ‘সভ্নাঁ জীয়াকা তুম্ দাতা (একো দাতা),সো মৈঁ বিসরে না জাই’এমন ছবি এঁকেছিল তা এখন সংস্কার হয়ে গিয়েছে।অগত্যা তার সন্তষ্টির জন্য বহু চেষ্টা ব্যর্থ হলে ক্ষান্তি দিয়ে বলি বাপু দৈবই এখন ভরসা।
বিশ্বাস করুন ডাক পেলাম অদ্ভুতভাবে।সাদা চোখে দেখলে ব্যাপারটা কাকতালীয়।আর অন্তরের চোখে দেখলে মনের গহনে এক ফোঁটা আশা হন্যে হয়ে খোঁজে রাস্তা।হেঁয়ালি কথা ছেড়ে খুলে কাশি।ওষুধের দোকানে দেখা স্কুলের বন্ধু কালুর সাথে।আমার জিজ্ঞাসা,ট্রেক করছে কিনা?উত্তর,তিন বছর পর অমরনাথ যাবে এবার।চোখের সামনে ভেসে ওঠে,গম্ভীর গিরিশৃঙ্গ, নীল আকাশ,রহস্যঘন বনের গায়ে ভাসা মেঘ,ঘাসের সবুজের মাঝে নানা রঙের ফুল আর অনাড়ম্বর জীবনের স্রোত।কালুদের সঙ্গে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করলে জানায়,আগে অনুমতি নিতে হবে অমরনাথ শ্রাইন(Shrine) বোর্ডের।সমস্ত ব্যাপারটা যা বুঝলাম তা বলি-অমরনাথ যাত্রায় যাবার আগে আপনাকে তাদের সাইটে মেডিকেলের নির্দিষ্ট ফর্মটা ডাউনলোর্ড করে প্রিন্ট নেবার পর বলে দেওয়া হাসপাতালে গিয়ে করে নিন নিজের মেডিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ডাক্তার বাবুরা ফর্মে রিপোর্টি লিখে সই ও ষ্ট্যাম্প করে দেবে। এরপর আধার তিন কপি পাশপোর্ট ফটো আর টাকা নিয়ে চলে যান অনুমতির জন্য নির্দিষ্ট ব্যাঙ্কে।সব মিটলে টিকিট কেটে‘হর হর মহাদেব’বলে উঠে পড়ুন যানে।অমরনাথ যাত্রা শুরু ৩০জুন।আর আমি যখন জানছি সেটা ১৭ মে।তার ওপর দীর্ঘ সময় একা না বেরনোর অভ্যাস খুইয়ে সাহস কমেছে, সঙ্গী ও পাইনি।মনের ভিতর ভাঙা-গড়ার খেলা।
“এক বাণী করুণানিধন
কি/ সো প্রিয়
গতি ন আনকী”।
করুণাময়
রামচন্দ্রের এই একই রীতি,যার আর কোন গতি নাই,অসহায়,সেই তার
প্রিয়।বাড়ি ফিরত পথে তিনি দেখিয়ে দিলেন ল্যাম্পপোষ্টে সাঁটা ছোট পোষ্টার ‘তুষারতীর্থ অমরনাথ যাত্রা’।জীবনে মাঝে মাঝে এই ভাবে মিরাকেল সবার
ঘটে।বাইক থামিয়ে
দেওয়া নম্বরে ফোন।ও প্রান্ত থেকে তিনি সব শুনে ডাকলেন পরদিন,সঙ্গে নিতে বললেন আধারের ফোটকপি আর চারটে পাশপোর্ট ফটো।এককপি ফটো মেডিকেল ফর্মে
লাগবে তিন কপি পরচিতে।পরশু যাবো পরচির জন্য SBI এ।ব্যাঙ্ক ম্যানেজার ব্যস্ত।অপেক্ষা।আমরা যাবো বালতাল রুটে, পহেলগাঁও পথে পারমিশন পায়নি গ্রুপের বেশীরভাগ যাত্রী।মনের আনন্দে অল্প বেসুরো।তা হোক,ফিরবো পহেলগাঁও হয়ে শ্রীনগর ছুঁয়ে বৈষ্ণদেবীকে
প্রণাম করে।ডাক এল ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের।আমাদের যাত্রার তারিখ জেনে,ডায়রি দেখে জানালেন দশ
তারিখে যাত্রার পরচি পাবো।এরপর একশো কুড়ি টাকা কাউন্টারে জমা।পরচি প্রস্তুত এবার টিকিট কাটা।স্বপনদা ফোনে দেখে নিদান দিলেন-ন’টা টিকিট আছে হিমগিরি এক্সপ্রেসে,বাড়ি ফিরে,অবশ্যই টিকিট কাটি।
নির্দিষ্ট দিনে গাঙ্গেয় বঙ্গের সমতল থেকে হিমগিরির অন্দরে প্রবেশের অধিকার নিয়ে চড়ে বসলাম ট্রেনে।আপার সাইড বার্থ।সহযাত্রীদের ব্যাস্ততা-উদবেগ,নীচু-উঁচু,মোটা-মিহি,বিভিন্ন স্বরের রাগ-অনুরাগ।মুখ গুঁজে পড়ে থাকা প্রাত্যহিকের ঘেরাটোপ কাটার খুশির বাতাস মনে।কাজ নামক প্রভুর দিন পনের থাকবে না শাসন।ভাবনার সুর কাটে পাশের কুপের এক যাত্রীর কথায়-‘এত বড় বস্তা সীটের নীচে ঢোকাবেন কি করে!’আর একজন,‘আচ্ছা বেআক্কেল মানুষ আপনি।’বৈরাগ্য সুলভ হেসে,‘আক্কেলও আছে আর বস্তা ও ঢুকবে,আপনারা বাঙলায়,ইচ্ছে হলেই মুড়ি পান,আমি থাকি কাঠুয়ায়।মুড়ির অভাব যে কি হয় তা মুড়িখোরেরা মর্মে-মর্মে বোঝে’।’
গাড়ি ছাড়বার অপেক্ষায়।রাত বারোটা।হ্যাঁচকা দিয়ে গাড়ি গড়ালো।তালে তালে গতিও।শহর ছেড়ে শহরতলির আলো-আঁধার পেরিয়ে গাঢ় অন্ধকারে জোনাকির লুকোচুরি।গাড়ির ভিতর ক্রমশ শান্ত থেকে নিঃশব্দ। মাঝেমধ্যে মুখর রেলগাড়ি গতি-শব্দ আর নাকের গর্জনে।
দেবাশিষের ডাকে ঘুম ভাঙলো।পাটনা স্টেশন।প্লাটফর্মে নেমে দুজনে চায়ে গলা ভিজিয়ে গাড়িতে ওঠা।দুচার কথা সেরে দেবাশিষ গেল নিজের কামরাতে। সার্সি আঁটা জানলার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মাঠ-ঘাট,খেত-খামার,নদী-নালা, নগর-উপনগর,মানুষ-যানবাহন।স্বচ্ছ নীল আকাশের মেঘ সর্বদা সঙ্গী। সে অর্থে তীর্থযাত্রী আমি নই। তীর্থের ভেক নিয়ে হিমালয়ে... রঙ,রূপ,রসে মজিয়ে মনটা মেরামতের আশায়।
‘কোথায় যাচ্ছেন অমরনাথ?’ উল্টোদিকে বসা যাত্রীর কৌতূহলী প্রশ্নে- ‘হ্যাঁ’। ‘একা?’‘না,ত্রিশ জনের গ্রুপ। আপনি?’জিঞ্জাসা আমার। উত্তরে জানলাম উনি আম্বলা ক্যান্টনমেন্টে নামবেন।সৈন্য-বাহিনীতে আছেন।নদীয়া জেলায় বাড়ি। নাম দেবদত্ত মিত্র।বিটলেমিতে পেল আমায় ‘নামে তিনটে পদবী?’মৃদু থেকে হো হো হাসির স্রোত,‘আসছি, পাশের কামরা থেকে বন্ধুর খোঁজ নিয়ে।’
অমরনাথ যাত্রায় যাচ্ছি শুনে পরিচয় হোল আরও চার সহযাত্রীর সঙ্গে। ছন্দাদি অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপিকা। একা ঘুরে বেরানোটা ওনার নেশা।দলবেঁধে ঘুরতে উনি ভালবাসেন না।অবিবাহিত।হিমালয় ওনার প্রথম পছন্দ। অমরনাথে চারবার এসেছেন।তিনবার দর্শন হয়েছে।পহেলগাঁও পথে দুবার একবার বালতালের পথে। এবার আবার পহেলগাঁও পথে।বালী থেকে বিকাশবাবু,স্ত্রী ও বাব-মা কে নিয়ে বালতাল পথে আমাদের সহযাত্রী।আর একজন আপারবার্থ থেকে কচিৎ কখন ও নেমেছেন,কানে হেড ফোন লাগিয়ে মোবাইলে কিছু দেখে চলেছেন অথবা কথা বলছেন ফোনে। ‘আপনারা কি হেঁটে উঠবেন?’আমার প্রশ্নে বিকাশবাবু জবাব,‘না,আমরা দুজন ঘোড়াতে যাব।মা-বাবা ডুলিতে।’প্রতি প্রশ্নে জানায়,‘ইচ্ছেতো হেঁটে ওঠার,কি হবে জানি না।’বালতাল হয়ে
যাবো শুনে ছন্দাদি
বললেন,‘অমরনাথে রাত্রিবাস যদি করেন তাহলে ঠিক আছে,নচেৎ বেশ কঠিন।অবশ্য
হাঁটুর জোর থাকলে,অসম্ভব না’।বিনয়ী জবাব‘হ্যাঁ থাকবো,গুলজার হোলি ক্যাম্পে আর হাঁটা অভ্যাস
আছে আমার’।.দিদি হেসে‘ও,তাহলে পারবেন।’চা গরম,গরম চায়ে,শুনে ‘চা খাবেন তো সবাই’দিদির প্রশ্নে বিকাশবাবুর
স্ত্রী ভারতী জানালেন,উনি চা খান না।
চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে মেসোমশায়ের দিদিকে প্রশ্ন-‘অমরনাথের পৌরাণিক গল্পে শুকপাখি কি পায়রা?’ ‘কেউ নিশ্চয় বলেছে আপনাকে পবিত্র গুহায় পায়রা দেখলে জীবন সার্থক।’হাল্কা হাসির ঝিলিক খাওয়া ঠোঁটে ‘এ ব্যাপারে জ্ঞান-গম্যি একদম নেই মেসোমশায়,তবে শুকপাখি পুরাণ বা রূপকথায় লেখক বা কবির কল্পনা,বাস্তব অস্তিত্ব আমার জানার বাইরে।চায়ে চুমুক দিয়ে,তবে পায়রা এ গুহার বাসিন্দা অনেক দিনের।ভগিনী নিবেদিতার লেখা‘স্বামীজিকে যে রূপ দেখিয়াছি’ বইয়ে বলেছেন,‘আর এখন গুহা প্রবেশ করিয়া তাঁহার বোধ হইল,যেন মহাদেব সশরীরে তাঁহার সন্মুখে বিদ্যমান।অসংখ্য যাত্রী কোলাহল করিয়া দলে দলে গুহা প্রবেশ করিতেছে এবং মাথার উপরে পারাবতকুল ঝটপট শব্দ করিয়া উড়িতেছে’।স্বামী বিবেকানন্দ এসেছিলেন ২৯,জুলাই ১৮৯৮।১২৫ বছর আগে যখন গুহায় পায়রার হদিস পাচ্ছি মানতে অসুবিধা নেই আমার। পায়রা হয়ত পুরাণকারের কল্পনায় শুক।’‘দিদি,স্বামী অভেদানন্দও তো এসেছিলেন?’ভারতীর প্রশ্নে,‘হ্যাঁ,স্বামী অভেদানন্দএসেছিলেন ১৯২২এ,’উত্তর দিদির।‘শুনেছি মহর্ষি ভৃগু,আদি শঙ্করাচার্য অমরনাথ গুহা দর্শন করেছিলেন।’মন্তব্য আমার।হাল্কা হাসি ঠোঁটে,বাঁহাতে বাঁধা ঘড়ি দেখতে দেখতে ‘হ্যাঁ, এছাড়া গুরু নানক,স্বামী রামদাসও স্বামী রামতীর্থ,শৈবধারার সাধক স্বামী বিদ্যাধর, পঞ্চদশ শতাব্দীর কাশ্মীরের শাসক বাদশাহ জয়েন-উল-আবদিন,প্রবোধকুমার সান্যাল ওনাকে বলেছেন দৈতকূলে প্রহ্লাদ।থাক সে কথা।জম্বু-কাশ্মীরের বিখ্যাত সাধক ভগবান গোপীনাথজী।গোপীনাথজীর সঙ্গে আবার বাংলার যোগ আছে জানেন’।সবার অনুসন্ধিৎসু চোখে ভ্রূকুটি দেখে দিদি,‘ব্যাপারটা কথিত,ভগবানের জন্মের দিনে (৩জুলাই১৮৯৮) স্বামী বিবেকানন্দ নবজাতককে আর্শীবাদ করে আসেন’। ‘তারপর?’আমাদের প্রশ্নের জবাবে দিদি হাসতে হাসতে‘তারপর আবার কি? ওইটুকু জানি।তবে যদি… কাশ্মীর,অমরনাথের ইতিহাস শুনতে চান বিকেলে বলবো।’ বিকাশবাবু সম্মতির ঘাড় নেড়ে‘নিশ্চয় শুনবো,কাগজে পড়া বুটা মালিকের গুহা আবিষ্কার ছাড়া কিছুই তো জানি না’।
বিকেলে চা পর্ব চুকিয়ে শুরু হল ‘প্রবাদ আছে এই কাশ্মীর উপত্যকা ছিল জলের নীচে, নাম ছিল সতীসর। সেখানে দৈত্যদের বাস। মানুষজন দৈত্যদের ভয়ে থাকত ভীত-সন্ত্রস্ত। ব্রহ্মা পুত্র কশ্যপ এই দোর্দন্ড প্রতাপ দৈত্যদের বধ করেন মহামায়াকে তপস্যায় তুষ্ট করে। এই জলমগ্ন উপত্যকাকে উনি করে তুললেন সুজলা সুফলা। মনুষ্য বসবাসের উপযোগী। ক্রমে দলে দলে মানুষ বাস জমালো সতীসরে।মহর্ষি কশ্যপের নামে নতুন উপত্যকার নাম হল কশ্যপমার বা কশ্যপমীর।এরপর নাগরাজ তক্ষকের হাতে শাসন ভার তুলে দিয়ে মহর্ষি কশ্যপ ফিরে গেলেন অযোধ্যায়। কশ্যপমার হল আজকের কাশ্মীর।অনেকে বলেন‘কাশ্মীর’ শব্দটি প্রাচীন সংস্কৃত ভাষা কাসমীরা থেকে এসেছে।কাস্মীরা শব্দের স্থানীয় ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল জল থেকে উদ্ভূত ভূমি।নীলমত পুরাণের বক্তব্য ও প্রায় এক্ই রকম।
বহু বছর কেটে গিয়েছে,কশ্যপমারের মানুষ সুজলা সুফলা প্রকৃতির দানে
সুখ সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ন।পরিব্রাজক ঋষি ভৃগু উপস্থিত হলেন সেখানে। প্রচার করলেন অমরেশ্বের শিবের
অমরকথা।শ্রাবনী শুক্লা চতুর্থীতে তার দেওয়া দেবদণ্ড(ছড়ি) সামনে নিয়ে যাত্রা শুরু করবার বিধান দিলেন।দেবদণ্ড হাতে থাকলে পথ হবে বিপদমুক্ত।আর
বললেন শ্রাবনী পূর্ণিমার পূর্ণলগ্নে অমরেশ্বরের দর্শনে মানুষ পাবে অমরত্ব।কিছুকাল
পর মানুষ এই কঠিন যাত্রার কথা গেল ভুলে। এর পর এলেন জগদগুরু
শঙ্করাচার্য।কাশ্মীরের বিখ্যাত পণ্ডিত মুন্ডন মিশ্রকে তর্কে পরাজিত করে তাঁকে নিয়ে
দেবদণ্ড হাতে অমরনাথ দর্শনের পর থেকে পুনরায় শুরু হল যাত্রা।আগে ছড়ি যাত্রা বা ছড়ি মুবারক হতো অমৃতসর থেকে,ডোগরা
শাসনকালের প্রথম দিকে ছড়ি যাত্রা স্থানান্তরিত
হয় শ্রীনগরে।অমৃতসরের আগে হতো মধ্যপ্রদেশ থেকে।বর্তমান শ্রীনগরের দশনামী আখড়ার দায়িত্বে ছড়ি যাত্রা চলে।’
তাহলে মেষপালক বুটা মালিক? ভারতীর প্রশ্নে,দিদি বললেন, ‘ওটা আধুনিক কথ্য ইতিহাস,তার আগে আরো কিছু তথ্য আছে।সম্রাট আকবরের সভাসদ সুপন্ডিত
আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে বিশদ বিবরণ দিয়েছেন অমরনাথ যাত্রার।সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাশ্মীর ভ্রমণকালে সফরসঙ্গী চিকিৎসক ফ্রাঁসোয়া বার্ণিয়ের ‘ট্রাভেল ইন দ্যা মুঘল এম্পায়ের’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন অমরনাথ গুহায় হিন্দু তীর্থযাত্রীদের পূজার কথা।আফগান শাসনকালের শেষের দিকে,১৮১৯
খ্রীষ্টাব্দে ধর্মপ্রাণ
ধনী পণ্ডিত হরদাস টিকু তীর্থযাত্রীদের জন্য সারা জীবনের জমানো দু-লক্ষ টাকা খরচ করেন অমরনাথ যাবার পথ,থাকার জায়গা,খাদ্যের ব্যবস্থা করতে।এরপর ১৮৩৫-১৮৩৮ এ কাশ্মীর ভ্রমণ করেন ব্রিটিশ শাসক ও পরিব্রাজক গডফ্রে টমাস
ভিগনে।১৮৪২ এ প্রকাশিত হল তাঁর লেখা ‘Travels in Kashmir, Ladak, Iskardo’ সেখানেও তিনি দিয়েছেন অমরনাথ গুহার বিবরণ।
এবার আসি বুটা মালিকের কথায়।জনশ্রুতি তিনি অমরনাথ গুহার পুনঃ আবিষ্কার করেন।ভেড়া চড়াতে- চড়াতে তিনি আশ্রয় নেন গুহায়।গুহাতে এক সাধু তীব্র ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা পাবার জন্য তাকে দেন জলন্ত কয়লার কাঙরী।বাড়ী ফিরে তিনি দেখেন কাঙরীর কয়লা রূপান্তরিত হয়েছে সোনায়।আনন্দিত বুটা সাধুকে ধন্যবাদ জানাতে আবার ফিরে যান গুহায়।কিন্তু সাধুকে তিনি খুঁজে পেলেন না,বদলে দেখেতে পান বরফের শিব লিঙ্গ।অদ্ভুত এই ঘটনা তিনি প্রতিবেশিদের শোনালেন।প্রচার হল গুহার মাহাত্ম।ঘটনাটা ১৮৫০এর বলে অনেকে মনে করেন। উনারা তীর্থ যাত্রীদের পথ দেখিয়ে শুধু নিয়ে যেতেন না,তীর্থ যাত্রীদের মন্ত্র পড়িয়ে করাতেন গুহায় বরফানি বাবার পূজাও।বর্তমান তাঁদের বংশধরেরা পহেলগাঁও এর বাটাকোটের বাসিন্দা।বুটা মালিকের প্রপৌত্র গুলাম নবি মালিকের পৌরহিত্যে ১৯৪৭ এ রানি তারাদেবী (মহারাজা হরি সিংএর স্ত্রী)অমরনাথ গুহায় করেছিলেন অমরেশ্বর শিবের পূজা।স্মারক হিসাবে রানী ওনাকে উপহার দেন মাজমা(খেজুর ভর্তি তামার ট্রে)। সান্মানিক অর্থ হিসাবে ওনারা এক তৃতীয়াংশ ভাগ পেতেন পূজার প্রনামীর।২০০০ সালে গঠিত হয় সরকার পরিচালিত অমরনাথজী শ্রাইন বোর্ড।এরপর শ্রাইন বোর্ডের নিয়ন্ত্রন চলে সব কিছু’।
‘পরিষ্কার হল না দিদি, ১৮৪২এ প্রকাশিত গডফ্রে টমাস ভিগনে বই বলছে অমরনাথ গুহার কথা।১৮১৯এ বললেন পণ্ডিত হরদাস টিকুর কথা।এই ক’বছরে মানুষ ভুলে গেল!গুহার কথা যাকে আবার পুনরাবিষ্কার করতে হল’? হতে পারে কারন আত্মবিস্মৃত জাতি আমরা,আবার না ও হতে পারে’। হাসিমুখে ‘এ সব বির্তকে আমি নেই,ওসব ঐতিহাসিকদের কাজ।মেনে নিলে,পরিশ্রম কম।’
ঘনায়মান সন্ধ্যা। মাথার ভিতর তথ্যের গজগজানির সঙ্গে মানসিক আতঙ্ক।প্রাকৃতিক দূর্যোগে অনেকবার ভন্ডুল হয়েছে যাত্রা,এমনকি কাছাকাছি পৌঁছেও বিনা দর্শনে ফিরে আসতে হয়েছে যাত্রীদের।সন্ধ্যার আলো-আধাঁরির মতোই এই যাত্রা অনিশ্চিত আশঙ্কায় ভরা।
জম্বু-তাওয়াই নামলাম বেলা দেড়টা।তাওয়াই হল মূল নদী, মন্দির নগরী জম্বুর।আমরা এখন যাবো বৈষ্ণোদেবী শ্রাইন বোর্ড পরিচালিত আস্তানাতে।রেল ওভার ব্রীজ পেরিয়ে এক নম্বর প্লাটফর্ম ফেলে
রাস্তা। মিনিট দুয়েক হেঁটে ডানদিকের বাঁক ঘুরে বৈষ্ণবী ধাম, কালিকা ধাম ও সরস্বতী ধাম।আমরা থাকবো সরস্বতী ধামে।অনলাইন বুকিং ছিল বলে সিকিউরিটি চেকিং পরে লিফটে করে পৌঁছে যায় চারতলাতে।ষোল বেডে্র ডর্মি।মহিলাদের থাকার ব্যবস্থার জন্য অন্য রুম।এ ছাড়া এসি ডর্মি ,ডাবল বেড,ট্রিপেল বেড এসি ও নন-রুম ও পাওয়া যায়।যে যার নিজের বিছানার দখল নিয়ে স্নানপর্ব সেরে ক্যান্টিনে।হরেক রকম নিরামিষ
পদ থেকে পছন্দের খাবারের দাম মিটিয় কুপন সংগ্রহ।এরপর খাবার পরিবেশনের জায়গায় কুপন জমা করলে খাবার।
পেট পুজা সেরে দেবাশিষ,সংগ্রামদা,পঙ্কজদা আমি স্থানীয় কিছু দ্রষ্টব্য থাকলে দেখব বলে রাস্তায় নামি।সামনে আটো স্ট্যান্ডে জিজ্ঞাসায়,উত্তর আসে রঘুনাথ মন্দির,শিব মন্দির আরো কিছু নাম বলেছিলেন।ভাড়া আস-যাওয়া দু-হাজার টাকা।যখন শুনলো আমাদের সন্ধ্যার আগে ফিরতে
হবে তখন প্রস্তাব এল বাগ-ই-বাহুর। আসা যাওয়া দেড় হাজার লাগবে।এগিয়ে আর এক জনের সঙ্গে দাম করলে
ভাড়া কমলো অস্বাভাবিক।সন্দেহ হওয়াতে সামনের জে কে পুলিশকে জিজ্ঞাসা। হেঁটে সামনের রাস্তা থেকে বাস ধরবার পরামর্শ
দিলেন উনি।বাস কন্ডাক্টারকে বাগ ই বাহু-র কথা বললে,যেখানে নামাবে
সেখান থেকে অল্প হাঁটলে পৌঁছে যাবো গন্তব্যে।
বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বাসের দেখা
নেই।বাধ্য হয়ে হাঁটা।বাসের আশায় মাঝে মাঝে পিছনে তাকানো।একসময় আশা ছেড়ে গতি বাড়ালো হাঁটার।সেনা বাহিনির অফিস-কোয়াটার-ব্যারাক পিছনে রেখে রাস্তা এবার চড়াই।তাওয়াই নদী অনেক নিচে সাপের মত
বয়ে চলেছে।মোটামুটি চার কিমি যাত্রা শেষে বিরাট হনুমান মূর্তি।খাড়া রাস্তার শেষে বাগ ই বাহু।ডান পাশের রাস্তা খাড়া উঠেছে
বাগ ই বাহু ফোর্টে।ফোর্টের ভিতর কালী মন্দির।স্থানীয় নাম বাওয়ালি মাতার মন্দির।বাগ ই বাহু বাগানের প্রবেশ মূল্য
দশ টাকা।এছাড়া ফাউন্টেন শো,অ্যাকোরিয়ামে মাছ দেখার জন্য দর্শণী আলাদা।টিকিট কাটতে যাবো,পঙ্কজদার চিৎকার,‘টিকিট কাটবেন না,এখুনি ফিরতে হবে।স্বপনদার ফোন,সাড়ে সাতটার মধ্যে এসে
যাবে আমাদের যাত্রার বাস।কাল সকালে নয়,আজি রাতেই রওনা দিতে হবে
বালতালের জন্য’।সামনে চায়ের দোকানে চায়ের চুমুক শেষ করে অটো-হাঁটা-লিফট-চারতলা।স্যাক পিঠে নীচে।ফুটপাথে অপেক্ষা।বাস এলে পিছনের ডিকিতে স্যাক রেখে জানলার ধারে সিট দখল।শহরের মধ্যে দিয়ে ধীর গতিতে এগোচ্ছে বাস,কখনো থামছে সিগন্যালে,আবার চলছে।হঠাৎ বাসের ইজ্ঞিন স্তব্ধ।সামনে যতদূর চোখ যায় পরপর গাড়ী।প্রথমে ভেবেছিলাম জ্যাম।সি আর পি এফ কথায় নিজেদের লাগেজ নিয়ে নামলাম গাড়ী
থেকে।স্বপনদা জানালো
চেকিং হবে,সবাই আধার আর পরচি হাতে রাখবেন।বাস থেকে নেমে হাঁটা।লাইনে দাঁড়ানো।সাপের মত আঁকা-বাঁকা লাইনের কোথায় মুখ
কোন রকম আন্দাজ করা মুশকিল।শামুকের গতিতে এগোচ্ছে লাইন আর সময় ছুটছে
ঘোড়ার বেগে।রাত ১১টা নাগাদ আধার, পরচি চেকিং করে প্রত্যেকের হাতে ধরানো হচ্ছে বিশেষ ব্যাচ যেটা গলায় ঝোলাতে
হবে।এরপর ল্যাগেজ পরীক্ষার লাইন।ধীর গতি।যখন সেখানে পৌঁছালাম তখন সময়
ও শরীর দুটোয় বারোটার ঘরে।প্রথমে যন্ত্র দিয়ে চেকিং,সন্দেহ হলে ব্যাগ খুলে
দেখাতে হবে।এরপর হাঁটতে হাঁটতে বাস স্ট্যান্ড।গরম আর খিদেয় শরীর অবসন্ন।স্ট্যান্ডের উল্টোদিকে লঙ্গরে
খান চারেক ঠান্ডা চিমড়ে লুচি সামান্য তরকারী দিয়ে উদরপূর্তি করে বাসস্ট্যান্ডে আমাদের
বাসের সামনে মাঠে কাগজ পেতে অপেক্ষা।সব গাড়ী ছাড়বে একসঙ্গে রাত তিনটে নাগাদ।সাড়ে তিনশো-চারশো কিমি যাত্রাপথ।
জানলার পাশে সিট আমার।ট্রেনের ধকল,সারাদিনের ছুটোছুটি,এরপর আছে চিরবিরানি গরমে নেতানো শরীর।জেগেছিলাম তাওয়ায় নদীর সেতু পেরোনো পর্যন্ত। এরপর নিদ্রার গ্রাসে। রাতের অন্ধকার আর ভোরের আলোর সন্ধিক্ষণে চোখ খুলে দেখি পাহাড়ের মাথায় বিশ্রাম নেওয়া মেঘেদের আরমোড়া ভাঙা।ঘুমন্ত বাড়ি ঘরের বাগানে লাল হলুদ গোলাপী সাদা ফুলের বাহার।কোথাও সবুজ মখলমী পাহাড়।কোথাও ধস নামা পাহাড়ে ধূসর খত। দু-একটা ঘুম ভাঙা পাখীর অলস ডানা মেলেছে আকাশে।পাখীর কূজন শোনবার জো নেই গাড়ীর একঘেয়ে শব্দে।হিমেল উতলা বাতাসে শরীরে কাঁপন লাগলে কোলের ওপর রাখা উইন্ড-চিটার পরে জানলা টেনে সার্সিতে চোখ রাখি।বাসের ভিতরে তখনো কারো ঘুম ভাঙ্গেনি।পথের দেবতাকে প্রণাম জানায় এমন আবেশ লাগা ভোরের সাক্ষী করার জন্য।
বিরাট প্রান্তরের পাশে বাস থামল।নেমে আসি বাস থেকে। রাস্তার একপাশে পাহাড়,আরেক পাশে বিরাট মাঠ। মাঠের একদিকে গোটা কুড়ি-বাইশ খাবারের ভান্ডারা,আট-দশেক মেডিক্যাল ক্লিনিক।অন্যদিকে শৌচাগার। সর্পিল রাস্তা জুড়ে বাস,ছোট গাড়ী,মাঝে-মাঝে সি আর পি এফ ভ্যান।আমাদের নিরাপত্তায় সেনা-বাহিনী,-আধা-সেনাবাহিনীর চেষ্টায় কোন ফাঁকফোকর নেয়।বরাদ্দ সময় পৌনে এক ঘন্টা,অতএব দ্রুততার সঙ্গে খাওয়া ও অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করতে হবে।প্রতি কাঊন্টারে লম্বা লাইন।সব শেষ হল যখন এক ঘণ্টা সময় অতিবাহিত।ঘনঘন বাঁশি আর‘চ্যালিয়ে-- চ্যালিয়ে’আধাসেনার বুলিতে ত্বরানিত হল বাসে ওঠবার বেগ।সারিবদ্ধ গাড়ির আবার চলা রাজকীয় চালে।তিনমাথা,চারমাথার মোড়ে দেখতে পাই সমস্ত রকম যানবাহন,এমনকি পথচলা মানুষকে সেনারা আটকে রেখে যাত্রা-যানকে করে দিয়েছে পথ।এটা তাহলে যাত্রা করিডর!ভীষন বাসের বেগ।পথের পাশে পাহাড়ের খাঁজে,দোকানের-বাড়ীর-হোটেলের ছাদে,গাছের ডালে,রাস্তার ধারে ফুট দশেক অন্তর আধা সেনা আগ্নেয় অস্ত্র হাতে মোতায়ন যাত্রী প্রহরায়।বানিহাল ট্যানেল পেরিয়ে বেশ অনেকটা যাবার পর দুপাশে আকাশছোঁয়া সবুজ পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে সংকীর্ণ রাস্তা।ঘন নীল আকাশে ভেসে যাওয়া সাদা ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘ।অপার্থিব সৌন্দর্যের মধ্যে ছন্দপতন।ধস নামার জন্যে আপাতত যাত্রা স্থগিত, যতক্ষন না রাস্তা খোলে।এখন সেনা ব্যারাকে- স্নান,মধ্যাহ্ন ভোজন।যদি রাস্তা না খোলে রাতের নিদ্রাও হবে এখানে।সেনা ব্যারাকে ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম।হঠাৎ গুঞ্জন রাস্তা খুলেছে।দেবাশিস খোঁজ নিয়ে জানাল সবাই এগোচ্ছে বাসের দিকে।সুন্দর পরিবেশ সঙ্গে ক্লান্তির জন্য ইচ্ছে ছিল এখানে এক রাত কাটাতে।শঙ্কা জাগে মনে,নিজের ইচ্ছা গুলো ঠিক ঠিক মিলছে না বলে। জম্বুতে না দেখলাম বাগ ই বাহু,আর এখনেও কাটানো গেলোনা একটা রাত।অমরনাথ গুহা দর্শন হবে তো! সকলে দুপুরের খাওয়া সাঙ্গ করে হাঁটছি বাসের উদ্দ্যেশে।কিলোমিটার খানেক হেঁটে দর্শন মিললো বাসের।আবার পথ চলা শুরু।ঘড়ির কাঁটা বেলা এক ছুঁই ছুঁই।বাসের বেগ আগের থেকে তীব্র।তীক্ষ রোদের তেজ বাধ্য করল জানলার পর্দা টানতে।আধো অন্ধকারে ভাত ঘুমের আমেজ।ঘন ঘন বাঁশির আওয়াজে ছুটল নিদ্রা।বাস দাঁড়িয়ে আছে।বেশীর ভাগ সিট ফাঁকা।উঠে দরজার কাছে যেতে স্বপনদা চেঁচিয়ে—‘আপনার এক্সট্রা লাগেজ থাকলে দিয়ে দিন।রামদা সব নিয়ে শ্রীনগরে যাবে’।রামদা রাঁধুনী।বাস থেকে নেমে ডিকিতে থাকা অতিরিক্ত মাল পত্তর রাখা ছোট স্যাকটা যথাস্থানে রেখে আবার বাসে।আধাসেনার বাঁশি বাজছে সমানে।দু-জন সেনা এগিয়ে এসে গরু তাড়ানো করে সবকে বাসে তুলে নির্দেশ দিলেন বাস ছাড়বার।সাড়ে চারটা নাগাদ সোনমার্গ। রাস্তার পাশ দিয়ে খরস্রোতা নদী।নদীর ওপারে খাড়াই পাহাড়।পাহাড়ের ঢালুতে পাইন বন।সংগ্রামদা জানালেন নদীর নাম সিন্ধ।‘সিন্ধ না সিন্ধু?’আমার প্রশ্নে–‘সিন্ধু নদ,এসেছে তিব্বতের অধুনা চীনের মানস সরোবরের কাছাকাছি ঝর্ণা ও সেংগে জাংবো(সেঙ্গে খাবাব) নদীর মিলন স্থল থেকে। যা কারাকোরাম ও হিন্দুকুশ পার্বত্যভূমিতে বাধা পেয়ে গিলগিটের কাছে ভারতবর্ষ ছেড়ে প্রবেশ করেছে পাকিস্থানে।অমরনাথ থেকে উৎপন্ন অমরগঙ্গা বালতাল উপত্যকা ছুঁয়ে শোনমার্গের বিভিন্ন হিমবাহের গলা ঝর্ণার জলে পুষ্ট হয়ে সিন্ধ নামে বয়ে মিশে যায় ঝিলমে।
চলতি বাস থেকে ক্যামেরায় চোখ রেখে তুললাম কয়েকটা ফটো। পথের সৌন্দর্য এতই তীব্র ক্যামেরা ছেড়ে দুচোখ ছড়িয়ে দিলাম নীল আকাশ,সবুজ পাহাড়ের গায়ে। সিন্ধের জল ফণা তুলে নদী গর্ভের বড় বড় বোল্ডারে মাথা ভিজিয়ে কখনো দুপাশ দিয়ে ছলছল,কলকল ডাক দিয়ে যায়।মাঝে মাঝে রাস্তা কাটে ভেড়ার পাল।নদীর ওপারে ছোট ছোট গঞ্জ।ছবির মত ঘর-দুয়ার।নদীর ধারে দাম্ভিক সভ্যতার ইলেট্রিক পোষ্ট।প্রকৃতির রোষানলে দু-চারটে খুঁটি নদী বক্ষে শায়িত।নদীকে সাথী করে ডানদিকের রাস্তায় নীচের দিকে নামছে বাস।বাঁদিকে জাতীয় সড়ক দ্রাস-কারগিল হয়ে পৌঁছেছে লে-লাদাখ।
মেঘ চোঁয়া সোনালী আভায় জলে স্থলে পাইন বনে হিমালয়ের অনন্ত ঐশ্বর্যের পরমাশ্চর্য রূপ।নদীর রোদ-তাতা জল ক্লান্তি ধুয়ে শীতল হবার উদ্দীপনায় প্রানের উচ্ছ্বাস প্রকাশে আমরাও ক্রমশঃ ঠান্ডা থেকে শীতল।গরম জামা উঠল গায়ে কান-গলা চাপা পড়লো মাফলারে।পাইন বনে ফিসফিসানি নদীর সাথে সখ্যতা তার নিবিড়।বহুদূরের নিঝুম উপত্যকার শেষে সোনালী বর্ণের অচেনা হিম-শিখর। হিমালয়ের পথে-ঘাটে এই রকম অচেনা নানা বৈচিত্র মিটিমিটি হেসে হাতছানি দেয়।এই রহস্যে মোরা মাধুর্যেকে দেখতে যুগ যুগ ধরে নেশাগ্রস্ত মানুষ কাছে আসে তাঁর। বাস হঠাৎ গেলো থেমে। দিনের আলো নিভন্ত।নদী,পথ
থেকে সরে গিয়েছে দূরে। সামনে গাড়ীর সারি।পথের একপাশে কাজ চলছে জোজিলা ট্যানেলের।দূরে আলোর রোশনাই।স্বপনদা জানালো এক কিমি মত হাঁটলে বালতাল বেস ক্যাম্প।আগে গেলে তাঁবুটা ঠিক-ঠাক মিলবে।মোটর-যানের পাশ দিয়ে কিছুটা হাঁটার পর চলার পথ।অন্য রাস্তা দিয়ে গাড়ী যাবে বাস-স্ট্যান্ডে।ডাইনে-বাঁয়ে,সামনে-পিছনে আকাশ ছোঁয়া পাহাড়।ডান দিকে পাহাড়ের গা কেটে লে-লাদাখ জাতীয় সড়ক। ডান ও বাঁয়ে পাহাড়ের নীচে জোর কদমে কাজ চলছে জোজিলা টানেলের।উৎরায়ে নেমে সরু নালা টপকে বালতাল বেস ক্যাম্পের প্রথম তোরণ।তোরনের সামনে দু-চারজন আধাসেনা। প্রবেশের বাঁদিকে-ডানদিকে প্রশাসনিক সেনা-বাহিনীর,শ্রাইন-বোর্ডের তাঁবু।এরপর বিশেষ অতিথিদের তাঁবু।বেশ কিছুটা ছেড়ে বিভিন্ন টুর অপারেটর ও লাক্সারি তাঁবু। বাঁদিকে
খাদ তারপর হাল্কা সমতলকে ভাগ করেছে খরস্রোতা অমরগঙ্গা।ওপারে পাহাড়ী জঙ্গল।ডানদিকে সারি সারি ভান্ডারার স্টল।পিছনে ভান্ডারার কর্মীদের থাকার তাঁবু ও সারি সারি শৌচালয়। দ্বিতীয় তোরণ পর আম জনতার থাকার তাঁবু। এখনে আমাদের ব্যাগ,পরচি,আধার চেকিং হল সব।এরপর আবার লাইনে দাঁড়ানো। চেকিং হল ব্যাগ এবং শরীরের।এর পর তাঁবুর কাছে পৌঁছানো।
স্বপনদা আগে এসে ঠিক করে রেখেছিল তাঁবু।ভাড়া জনপ্রতি পাঁচশো টাকা প্রতিদিন।প্রসঙ্গত তাঁবু ভাড়া ফিক্সড নয়, অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী বাড়ে-কমে। নিজেদের বিছানার দখল নিয়ে,চায়ের খোঁজে বেড়ানো।
বৈদুতিক আলোয় ভাসা বালতাল উপত্যকা মুখর নানা প্রদেশের মানুষে।সবার গলায় জয় ভোলে।স্থানীয় মানুষের পথের পাশে বসেছে খাবার,গরম-পোশাক,জামা কাপড়,চায়ের,নিত্য---প্রয়োজনীয় জিনিস,জুতোর এমন কি ট্যাটু করবার দোকন সাজিয়ে।বেস হাসপাতালের পাশে পুরনো হেলিপ্যাড।হেলিপ্যাডের পর বিরাট মাঠ,মাঠ ছাড়িয়ে বাসস্ট্যান্ড।চোঁয়ানো আলোতে নদীর তরঙ্গে ঝিকিমিকি। নদীর ওপারে অস্পষ্ট আলোয় বৃক্ষের অবয়ব।মাইকে শিবের ভজন।মাঝে মাঝে গান থামিয়ে জয় ভোলে বলে,ঘোষণা হচ্ছে কিছু না কিছু জরুরি সূচনা অথবা-কেউ যদি অসুস্থতা বোধ করেন, অব্যশই হাসপাতাল বর্হিবিভাগে ডাক্তার দেখিয়ে নেবার অনুরোধ।
আমরা চা খেয়ে,ভান্ডারার প্যান্ডেলে ঢুকে ঢুকে রাতের খাবারের
পছন্দের মেনুর খোঁজে।এক ভান্ডারাকে চিহ্ণিত করে প্রথম তোরণের দিকে এগিয়ে চলি।ভিড় এদিকে কম।তোরণের
কাছে আধা সেনা পথ রোধ করে আমাদের ফিরিয়ে দিলেন।আমাদের বাংলা ভাষা শুনে এক জওয়ান ‘কলকাতা থেকে?’প্রশ্নের উত্তরে জানাই, ‘না আমরা হাওড়া থেকে।’‘আপনি’? ‘বর্ধমান’।ওনার কাছে জানলাম পঃবঙ্গের অনেক জওয়ান আছে এবার ডিউটিতে।চিহ্ণিত ভান্ডারা চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়ে পঙ্কজদার কথায় ঢুকে পরলাম জয় মহাদেব সেবাদার চ্যারিটেবিল ট্রাস্টের ভান্ডারার অন্দরে।আয়োজন বেশ জমকালো।ঘি মাখনো রুটি,ছোলার ডাল,ফুলকপির তরকারী,হালুয়া।ভান্ডারার বাইরে পরিবেশিত হচ্ছে কেশর দেওয়া গরম দুধ।কিন্তু,কিন্তু করে শেষমেশ একগ্লাস গরম দুধ খেয়ে রওনা নিজেদের
ডেরায়।
তাঁবুতে, জোর কদমে আড্ডা হাসি-ঠাট্টা।দেবাশিসের মোবাইলে আমার বাড়ী থেকে ফোন।কোথায় আছি?সবাই ঠিক আছি কিনা? এই সব অদ্ভুত প্রশ্নের কারন জানতে চাইলে শুনি সমস্ত সংবাদ চ্যনেলে দেখাচ্ছে অমরনাথ মন্দিরের কাছে ফ্লাশ-ফ্লাডে ভেসে গিয়েছে তাঁবু তীর্থযাত্রী রাস্তা-ঘাট।এরপর অন্যদের বাড়ী থেকেও উৎকণ্ঠার ফোন।স্বপনদা বাইরে গেলেন কি ব্যাপার বুঝতে।দু-চার মিনিট বাদে মাইকে ঘোষণা বাজলো কালকের যাত্রা স্থগিত।মনের অবিশ্বাস ভাবটা তখন ও কাটেনি।অমরনাথ গুহা থেকে মাত্র পনের-ষোল কিমি দূরে আমাদের অবস্থান,অথচ প্রকৃতিতে তার কোন প্রকাশ নেই।বাইরে উৎকণ্ঠায় সকলে,চেষ্টা করছে খবর নেবার।কোন সঠিক খবর কারো কাছেই নেই।বারং বার মাইকে সূচনা পরবর্তী ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত যাত্রা স্থগিত।
পরদিন ৯ তারিখ,সকালে উঠে অমরগঙ্গা তীরে পৌঁছানোর মতলব নিয়ে শুরু করি হাঁটা।সঙ্গী সংগ্রামদা,পঙ্কজদা আর দেবাশিস।যাবার রাস্তায়
ভাণ্ডারেতে গরম প্যাটিস-চা গলাধকরন
করে নদীর কিনারায়।কলকল জলের শব্দ।কিনারায় ঘাসে চোখ বুজে
বসে,একমনে নদীর ডাক শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে শরীর নদীর তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে
কোথাও যেন চলেছে।নদীর দুপাশে চেনা অচেনা মুখগুলো অস্পষ্ট হতে হতে এক সময়
একা।কিছুতেই থামতে পারছিনা। চরম অস্বস্তিতে
চোখ খুলে অমরগঙ্গার পাশ দিয়ে হাঁটা।নদীর ধারে যাত্রীদের
ঢল। পায়চারী,ঘাসের ওপর বসে গল্প,সেলফী, ছবি তোলা
কিছু না কিছুতে সক্রিয় সকলে।নদী বরাবর সোজা যতদূর দেখা যায় একপাশে পাহাড়ী অরণ্য।অন্য পাশে কিছুটা সমতল,তারপর যাত্রী-ক্যাম্প,শেষে উঁচু পাহাড়শ্রেণী।সেই পাহাড়ের গা-বেয় কার্গিল-লে যাবার রাস্তা।আর দৃষ্টি
যদি নদী বরাবর সোজা এগোয় তা হলে দিগন্ত মেঘের দখলে ধূম্র-ধূসড়।কাল ক্যাম্পে আসবার সময় চোখ ঠেকেছিল তুষার ঢাকা এক শৃঙ্গ,যার মাথায় পাতলা মেঘে চাপা অস্তমিত সূর্যের সিঁদুরের টিপ।
ব্রিজ টপকে অন্য পাড়ে এলাম।এ-পাড়ে সমতল অংশ কম।পাহাড়েব ঢালে বিভিন্ন গাছ,আর পাখির কূজন সঙ্গে অমরগঙ্গার কল কল রব।সবুজ মখমলি ঘাসের মাঝে ছোট ছোট সাদা-হলুদ ফুলের রঙের ছটা।হিমালয়ের পরিবেশ ফুল,পাতা,পাখী, নদী সবাই মিলে ভিন্ন বেশে ভিন্ন সুর তুলে অনুভূতির বৈচিত্র সৃষ্টি করে কণ্ঠে ভাসে, ‘হৃদয় আমার চায় যে দিতে,কেবল নিতে নয়.’।
যাত্রী ভীড় কম এপারে।গাছের ছায়াতে ঘোড়ার সহিসদের আড্ডা।ইতস্তত চড়ে বেরাচ্ছে তাদের শীর্ণ অশ্বকুল।আমরা ক্যামেরা নিয়ে ইতস্তত পায়চারী করতে করতে বন্দী করছি খন্ডচিত্র।ভাগ্যিস এই অঞ্চলে এখনো বীরদর্পী বহুতল নির্মাণ হয়নি।তাই মায়া মাখা শিশু সাদা মেঘের দল নির্ভয়ে আকাশের বুকে,পাহাড়ের চূড়ায় ভেসে ভেসে লুটোপুটি খাচ্ছে আনন্দের উচ্ছ্বাসে।হঠাৎ দৈতাকার বাদল ধূসর মেঘে ঢাকলো আকাশ।ফিনফিনে রোদের উজ্বলতায় মোলায়েম পরিবেশ।বৃষ্টি নামার ভয়ে গুটি গুটি পায়ে হাঁটা কাম্পের উদ্দেশ্যে।এপাড়ে আস্তেই অল্প অবগুন্ঠন খুলে অবাধ অকৃপণ মায়াবী আলোয় ভরে উঠলো উপত্যকা।বিকেলে গেলাম ডোমেল গেটে।এধারেও অনেকগুলো ভান্ডারা আছে।মাঝে মাঝে যাত্রীদের জন্য শৌচালয়,পানীয় জলের ব্যবস্থা।ক্রমশ চড়াই ভাঙছি। স্বচ্ছন্দে চলার উল্লাস স্তিমিত।ডান দিকে পাহাড়ের গায়ে সবুজ বনানী,কোথাও লেগে আছে না গলা বরফের মোটা আস্তরন,কোথাও ঝর্ণার ধারা নেমে নীচে মিশেছে অমরগঙ্গায়। বাঁ-হাতে ঘাস জমি,এরপর পাহাড়।জমিতে ইতস্তত ঘোড়া।পোষ্টের আলোয় আলোকিত রাস্তা।কাদা মাখা বিধস্ত গুহা ফেরৎ আসা যাত্রী দেখে কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তর ‘ভয়াবহ রাত কাটিয়েছি,বেঁচে আছি এই সৌভাগ্য…বুক কাঁপানো সে শব্দ…সর্বগ্রাসী কাদা জল পাথরের স্রোতে ভেসে যায় সব…আর্তনাদ ভেসে যাওয়া মানুষের… ওহ! মহাকাল!… কি কষ্ট! …মর্মান্তিক,করুণ…’চোখে জল, বাকরুদ্ধ।আর কিছু জিজ্ঞাসায় সায় দেয়নি মন।
আস্তানাতে ফিরে শুনি কাল শোনমার্গ যাবার প্রস্তাব। সাত-আটজন রাজী। সকালে পঙ্কজদা আর আমি বেরলাম গাড়ীর খোঁজে।নরম কুয়াসা ঘেরা পরিবেশ।বাসস্ট্যান্ডে দু-একজন গাড়ী চালকের সঙ্গে বাতচিতে,কেউ রাজী না যেতে।স্থানীয় একজন জানালেন কাল বকরি ঈদ,গাড়ী পাবোনা,নো এন্ট্রী থাকবে ফেরবার
সময় বাজারের রাস্তায়।ভাঙা হৃদয়ে ক্যাম্পে ফেরা।সবাই কাওয়া খাচ্ছে।বাবু আমাদের টিমের কনিষ্ঠ যাত্রী ছুট লাগালো কাওয়া বিক্রেতাকে ধরে আনতে।পিতলের বড় ঘড়ার মুখে কেটলির নল লাগানো পাত্র।নীচে কাঠকয়লার জ্বাল।কাগজের বড় গেলাসে পরিপূর্ণ উত্তপ্ত কাওয়াকে প্রথম আস্বাদন আমার।কাশ্মীরি এই পানীয়ে নাকি শরীরের ব্যাথা কমে,উত্তাপ আসে দেহে। খুব স্বাদু লাগেনি।তবু গলা মেলালাম দারুণ বলে।
দেবাশিষ ‘যাওয়া হবে না যখন চল নদীর ধারে।’ অমরনাথের দুর্ঘটনা বিশেষ
কোন ছাপ ছাপ ফেলেছে মনে হলনা যাত্রী হৃদয়ে।পরিবেশ স্বাভাবিক,সবাই জানতে ব্যাস্ত যাত্রা চালু হবে কবে।আধাসেনারা বক্তব্য কাজ চলছে ওপর থেকে অনুমতি এলেই শুরু হবে
যাত্রা।
অমরগঙ্গার ওপারে চলে এলাম।আমাদের কালকের বসার জায়গার
দখল আজ অন্য এক দলের।ওনাদের থেকে অল্প দূরত্বে স্থান নিলাম আমরা।কানে এল দেশের ভাষা,‘..আর্য শব্দ নিয়ে বির্তক আছে।বিদেশী পণ্ডিত ও তাদের অনুসরণকারীরা বলেন- অর ধাতু থেকে আর্য।অর মানে কর্ষণ। মানে আর্যদের
জীবিকা কৃষিকাজ। এদিকে ঋগ্ববেদে কৃষিকাজের কোন পরিচয় উল্লেখ নেই।সায়নাচার্যের মত হল ঋ ধাতু ণাৎ প্রত্যয় করে আর্য।ঋ ধাতু বলতে বোঝায় গমন,অর্থাৎ একস্থান থেক অন্য স্থানে গমন করত আর্যরা’।এটা সমর্থন যোগ্য।অন্যজন-‘এটা আমি ও মনে করি পশুপালন
ছিল আর্য জাতীর প্রধান জীবিকা। প্রমান,--‘প্রার্থনাকালে বলতেন--কল্যাণ হোক গরু,ভেড়া,ছাগল,ঘোড়া সঙ্গে নিজেদের স্বজনদের’। (ঋক১/৪৫/৬) ‘ঐ হিন্দু আণ্ডা,মুসলিম আন্ডার ব্যাপারটা কি দাদা?’ বিচিত্র প্রশ্নে কান সজাগ।‘এটা তুমি ‘পরিব্রাজক স্বামী অভেদানন্দ’বইয়ে পাবে।সে যুগে জম্বু আসার সরাসরি ট্রেন না
থাকার জন্য শ্রীনগরে আসতে হত রাওলাপিন্ডি
থেকে।ওনারা আম্বাল ক্যান্ট থেকে উঠেছেন লাহোড়ের ট্রেনে।প্লাটর্ফমে
হকারের হাঁক ‘হিন্দু আণ্ডা,মুসলিম আন্ডা।’বলে সিদ্ধ ডিম বিক্রি করছেন।হিন্দু আন্ডা হল হাঁসের ডিম আর মুসলিম আন্ডা মুর্গীর’।
পরদিন সকালে বেস হাসপাতালের সামনে পুরানো হেলিপ্যাডের মাঠে বকরী ইদের নমাজ।প্রায় চার-পাঁচশো ধর্মপ্রাণ মানুষের সমবেত প্রার্থনা।অনেকে আবার নমাজে না গিয়ে নিজেদের কাজে ব্যস্ত।মাঠে খানিক সময় কাটিয়ে,ক্যাম্পের উদ্দ্যেশে যাত্রা।আধাসেনাকে ঘিরে যাত্রীদের প্রশ্ন –‘কবে রাস্তা খুলবে’? এক সেনা তার মোবাইল যাত্রীদের ভয়াবহ রাতের ভিডিও গুলো দেখিয়ে প্রশ্ন ‘এই মৃত শরীরগুলোর ওপর দিয়ে হেঁটে কোন মানসিকতা নিয়ে তীর্থ দর্শন করবেন’?এরমধ্যে একটা ছবি দেখে সকলে আঁতকে উঠেছিলাম।এক সেনা বেলচা দিয়ে দেহ সরাতে গেলে শরীর আর মুণ্ডু আলাদা হয়ে গেল।বোবা আর্তনাদে থরথরিয়ে চলে আসি সোজা ক্যাম্পে।অফুরন্ত উৎসাহের পায়ের তলার মাটি সরে ঘোষণা করেছে ঠাঁই নাই।বেওয়ারিশ লাট লাগানো লাশ একদিকে,অন্যদিকে আমাদের মত অসংখ্য উৎসুক যাত্রী। মনের মধ্যে হাজার প্রশ্নের ঠেলাঠেলি।জবাব খুঁজতে ফাঁপরে পড়ে,বুকের ভিতর আঁকুপাঁকু যন্ত্রনা।ঐ লাশগুলোকে কেউ চিনছে না,চিনবে কিনা তাও জানা নেই।অথচ প্রত্যেকের মান-অপমান,রাগ-অনুরাগ-অভিমানের সূক্ষ্ম সুতার বাঁধনে বোনা ছিল সংসার।ঐ সন্তান হারনো মায়ের পাথরে মাথা ঠোঁকা অসহায় আর্তনাদ!ভয়ঙ্কর!নিরাশ্রয়,নিঃসঙ্গ,নিরবলম্ব শরীর, যেখানে এখন প্রাণ ধুক ধুক করে বেঁচে আছে।রুদ্র ভৈরবের উন্মুক্ত দ্বারে যেন দিন শেষের ঘোষণা।বাড়ীর জন্য মোচড় দেয় মনটায়।পঙ্কজদা আমাকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে‘ধ্যান করছেন নাকি’! সচকিত হয়ে হেসে–‘স্নান হয়ে গেল আপনাদের?’
বিকেলে অভ্যাস মত বেড়ানো।প্রতিটা ঘোষণাতে আমাদের কানখাড়া।কোন ঘোষণা পেলাম না যাত্রার ব্যাপারে। উন্মত্ত তোলপাড়-কি হবে,আমাদের? কপালে কি দর্শন নেই!ভাবনাটা এমন জেঁকে বসেছে যে মানসিক উদ্বেগে মন অশান্ত। ঝকেঝকে আকাশে ঘন ঘন কপ্টারের যাওয়া আসা।অস্বস্তি কাটাতে ক্যমেরার লেন্সে চোখ রেখে পটাপট সাটার টেপা।আমার ভ্রমণের দলিল রচনা করে রাখা।কোন এক অবসরে সেগুলোতে চোখ রেখে জাবর কাটবো।তাতে কি বোঝা যাবে মনের হা- হুতাশ।সন্ধ্যা গেলো, রাত এলো।ময়দান আলোকিত।এলোমেলো অস্বস্তিতে অবসাদের অন্ধকার সঙ্গে বিচ্ছিরি আলুথালু বৃষ্টি।বসা হল আবার।তিনজন বাদে সবাই একমত কাল চলে যাবার ব্যাপারে।কাশ্মীরাদি টিংকুদি বাবু সজোর ঘোষণা,কোনভাবেই তারা দর্শন না করে বালতাল ছাড়বে না।স্বপনদা সবাইকে থামিয়ে মাইকের ঘোষণা শোনবার চেষ্টায়।ঠিকমত শোনা না যাওয়াতে বাইরে এসে খবর নিয়ে জানালেন কাল পহেলগাঁও এর পথে যাত্রা হবে।মৃতসজ্ঞীবনী।সিদ্ধান্ত বদল।থাকছি কাল বালতালে।
আজ সকালের বালতাল অন্য চেহারা চারদিনে সংখ্যায় বেড়েছে মানুষ।যাত্রী চাপে অগোছালো চেনা ছন্দ।ভিড় প্রতিটা ভাণ্ডারেতে,দোকানে।চা নিতেও দিতে হবে লাইন। অগত্যা,ঘুমভাঙানিয়া চা বলে কথা।মগজের তর্কাসুররা যা পারে বলুক প্রাচীন তীর্থের টানে এত মানুষের ভিড়ে হৃদয়ে প্রসন্নতার অনুভূতি।চা পর্ব মিটিয়ে গন্তব্য আমাদের নদীর ওপারে।এত মানুষের আনন্দ উল্লাসে একা চলা নদীর তরঙ্গে বিস্ময়ের উচ্ছাস। অমরেশ্বর অমরনাথের নিজস্ব বিলাসভূমি।এখানের আকাশ-বাতাস,জল-জঙ্গলে মিশে আছে তাঁর অস্বিত্ব।জনগণের দেবতা তিনি।প্রকৃতিগত ভাবে আত্মভোলা সহজ সরল। ভক্ত খুশি থাকুক এই তাঁর লক্ষ্য।অন্যের কোন দুরভিসন্ধি থাকতে পারে সে কথা ভাবতে অপারক।তাই ভস্মাসুরকে নির্দিদ্ধায় শর্ত ছাড়া বর দেন,যার মাথায় হাত রাখবে সেই ভস্ম হয়ে যাবে।বরের সত্যতা যাচাই করতে শিবের মাথাতেই হাত রাখতে যায় ভস্মাসুর।শেষমেষ রক্ষা পান উনি বিষ্ণুর কারিকুরিতে।ভগীরথ গঙ্গা আনবেন মর্তে,কিন্তু কে ধারন করবেন সেই বেগ।মহাদেব নিজের জটাজালে ধারন করলেন গঙ্গাকে।সমুদ্রমন্থনে অমৃত পান করলেন অন্য দেবতারা,গরল পান করে হলেন নীলকণ্ঠ। বারবার নিজেকে বিপন্ন করে কল্যান সাধন করেছেন দেবতা-মানুষ-প্রকৃতির।অতি সাধারণ বেশভূষা। চুলে তেল নেই,না আঁচড়ানো রুক্ষ চুল জটার বাঁধনে।খুব অল্পে খুশি বলে তিনি আশুতোষ, পশুদের রক্ষাকর্তা বলে তিনি পশুপতি,সর্বশ্রেষ্ঠ বৈদ্য বলে তিনি বৈদ্যনাথ,গীতবাদ্য-নৃত্যকলার উদ্ভাবক তাই তিনি নটরাজ। আবার বাংলার গাজনে কোন ভেদাভেদ না রেখে ব্রাহ্মণ থেকে চণ্ডাল সবাই গলায় উপবীত পড়িয়ে মর্যাদা দিলেন ভক্তের। যে ভাবে সমাজের সব শ্রেনীতে বিভিন্ন নামে ওনার বিরাজ। তাঁকে আমআদমীর দেবতা ছাড়া অন্য কিছু কি বলা যায়? সেই আমআদমী দর্শনেচ্ছু ভক্ত তাঁর অপেক্ষায়।দর্শন তিনি অব্যশই দেবেন।হৃদয়ে জাগে বিশ্বাসের বাণী।
নদীর ধারে ভীষণ ভিড়।আসন পাতলাম
আমরা গাছের ছাওয়াতে।ঘন সবুজ পাতার ফাঁকফোকর থেকে আসা ভাঙা ভাঙা আলো এঁকেছে সবুজ ঘাসে নকশী কাঁথা।যতদূর চোখ যায় সবুজের বিচিত্র সমাবেশ।খানিক তফাতে জিরোচ্ছে তিন চার জন সহিস। তাদের ঘোড়া গুলো পরম তৃপ্তিতে
ঘাস চিবিয়ে,আনন্দ জানান দেয় হ্রেষাধবনিতে। দুটি ছোট
স্থানীয় বাচ্ছা আপন খেয়ালে তাদের দিদিমা বা ঠাকুমার সাথে মাঝে মাঝে মেতে ওঠে দুষ্টমি
আর ছুটোছুটিতে।বেদম বৃদ্ধা হাল ছেড়ে কখন রাগে,কখন হাসি ছড়িয়ে কিছু বলে।নবীন-প্রবীনের খেলা।শহুরে ধুলোভরা
চোখে পরিবেশ গুনে স্মৃতির দর্পনে ভাসা শৈশবের হারনো ছবি।
অপ্রত্যাশিত নারীকন্ঠে ‘এসকিউজ মি,আপনি ফটোগ্রাফার?’ কিছু বলার আগেই বাকপটীয়সী নারী নিজের পরিচয় জানিয়ে আমার হাতে মোবাইল দিয়ে ‘প্লিজ ছবি তুলে দিননা’।দলের অন্য সদস্যরা মিটি মিটি হাসিতে সমবেত গান ধরলো-‘ ঘরেও নহে পারেও নহে/ যেজন আছে মাঝখানে সন্ধ্যাবেলায় কে ডেকে নেয় তারে’।পঙ্কজদা ‘উঁহু,সন্ধ্যাবেলায় নয় সকাল বেলায়’।লজ্জায় মরি মরি।ভাগ্যিস আধুনিকা বাংলা বোঝেনা।ছবি তুলতে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে, ‘না ছবি তুলবেন না’,রাগত গলায় এক যুবক ফোনটা হাত থেকে নিল কেড়ে।‘ আবার জ্বালেতে এলে? এবার কি নতুন ফিকির? চলে যাও,বিরক্ত করলে পুলিশ ডাকবো’নারীর চাপা তপ্ত কণ্ঠ, হতবম্ভ।যুগলের আরো কিছু সংলাপ শোনার ইচ্ছাকে সামলে পিটটান দিলাম।
বেলা এগোচ্ছে।রোদের তেজ গা পোড়াই।তোয়াক্কা নেই যাত্রীদের।রাস্তায়,নদীর ধারে সর্বত্র তাদের গতির দোলা।হঠাৎ শ্যামলা যুবক এসে ভাঙা বাংলায় জিজ্ঞাসা ‘বাঙালী কিনা’? এরপর বড়বাজারে বছর-দুয়েকের কাজের অভিজ্ঞতা।কলকাতার মানুষের উচ্ছসিত প্রশংসা।‘সব বুঝলাম,খুলে কাশুন দেখি?’ পঙ্কজদার সোজাসাপ্টা প্রশ্ন।‘দাদা চাষীদের কাছ থেকে আমি কেশর কিনে,টুরিষ্টদের কাছে বিক্রি করি খুব কম দামে। অরিজিনাল শিলাজিত ও পাবেন’। ব্যাগ খুলে কেশরের ছোট ডিবে খুলে আসল কেশর কি ভাবে চিনব ইত্যাদির বিস্তারিত বিবরণ। দেবাশিসের জিঞ্জাসা‘দাম কত?’ ‘বাজারে দশ গ্রামের দাম প্রায় দু-হাজার টাকা,আমার কাছে পাবেন পাঁচশো টাকায়’।পঙ্কজদার দাম পঞ্চাশ টাকা।নাছোর যুবক দুশো টাকা,একশো টাকা,পঁচাত্তর টাকা শেষ দাম জানিয়ে বিদায় নেই।আমরাও উঠে ক্যাম্প মুখো।
ক্যাম্পে ফিরে দেখি মিটিং চলছে টেন্টে।সবার মুখে হাসি। ‘দাদা আজ যদি এখান চলে যেতেন,কেমন ফাঁকি পড়তেন ভাবুন?’বাবুর প্রশ্ন। স্বপন দা জানালো-‘কালকে বালতালের রাস্তা খুলবে।সকাল তিনটেয় বেরতে হবে কারন তিন দিনের জমা যাত্রী যাবে।ডোমেল চেকিং পয়েন্টে যত আগে দাঁড়াতে পারবো ততো আগে গুহার কাছে পৌঁছব।নতুন নিয়মে গুহা বন্ধ হয়ে যাবে বিকেল সাড়ে-চারটেতে।দেখে বালতাল ফেরৎ,পহেলগাঁও দিয়ে নামতে দেবে না আর ওপরে থাকতেও দেবে না।হাতে প্রত্যেকে আধার,পরচি রাখবেন গলায় ঝুলবে সেরিন বোর্ডের দেওয়া ব্যাচ।মনে রাখবেন ঘোড়া বা ডুলি ভাড়া নিলে তাদের কার্ড অব্যশই নিয়ে নেবেন।সময়ের মধ্যে গুহাতে পৌঁছাতে যারা হেঁটে উঠবেন ভাবছেন প্রত্যেকের ঘোড়াতে যাওয়া ভাল। ফেরবার সময় মনে হলে হেঁটে আসবেন’।পরামর্শ স্বপনদার।‘বেস হাসপাতালে ঘোষবাবু ভর্তি আছেন।খবরটা নিয়ে আসি’।উঠে পড়লেন স্বপনদা। পিছু নিলাম আমারও।স্যালাইন অক্সিজেনের বাঁধনে ঘোষবাবু ।ডাক্তার জানলেন উনার অবস্থা স্থিতিশীল। জটিলতা কিছু না হলে ডিসচার্জ বিকালে।
রাতের ঘুম উধাও।কখন তিনটে বাজবে।ঘুম ভেঙে ঘড়ি দেখা আবার শুয়ে পরা। রাত দুটোয় ঘুম ছুটলে দেখি সকলের বেরোবার প্রস্তুতি।‘হর হর মহাদেব’রব রাস্তায়। অথাৎ ঘুমছুট যাত্রী ডোমেল মুখি।পৌনে তিনটে বেড়োন। সবার গলায় বাজে ‘জয় বাবা অমরনাথ’।জনস্রোত,লক্ষ্য এক।উচ্ছ্বাস,ছোটাছুটি,জয়ধ্বনি।আধো অন্ধকারে এগিয়ে চলা।ডোমেল গেটের বাইরে থেকে অনেকে ভাড়া নিচ্ছে ঘোড়া।আমাদেরও আঠাশশোতে দর দামে চূড়ান্ত চারটে ঘোড়া।বাদ সাধলো স্বপনদার আশ্বাস ‘গেট পেরলে আরো সস্তা পাবো ঘোড়া’।ফল বিপত্তি।গেট পেরিয়ে দেখি যাত্রী তুলনায় ঘোড়া অপ্রতুল।ভাড়া চড়া। আটত্রিশশো কমে কিছু নেই।বহু কষ্টে সাড়ে-তিনে রাজী করিয়ে,যখন রওনা দিলাম তখন সকাল ছটা।
ঘোড়ার পিঠে পাহাড় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা না থাকার দরুন তীব্র আড়ষ্টতা,অস্বস্তি, ভয়।বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ।জল-মাটি-ঘোড়ার বিষ্ঠায় মিশ্র টল-টলে পাঁকের রাস্তা সঙ্গে ভয়ঙ্কর চড়াই বেয়ে পাক খেতে খেতে ক্রমশ উর্ধবগমন।হেঁটে আসলে এ পথ পেরোতে বেদম হতাম এ ব্যাপারে নিশ্চিত।আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ চুঁইয়ে নরম আলোয় ঝলমলে চারদিক।পিছনের শুভ্র গিরি শিখরে চকচকে উজ্জ্বলতা।সুর্য মাঝে মাঝে ধূসর মায়াবী মেঘে বন্দী।পিছনে সামনে অগণিত নাগরিকের মাথা।অসাবধানে অঘটন ও ঘটছে।সহিসদের কথা মত চড়াই ওঠার সময় সামনে ঝুঁকে উতরায়ে পিছনে হেলে বসার নিয়ম,বেনিয়মে ঘোড়া থেকে পতন।আহত হয়েও আবার চলা।বেয়ারা ঘোড়া!সে চলেছে,ডানদিকে সর্বনাশী গভীর খাদের পাশ দিয়ে।চোখের মুগ্ধতা গৌন, অজানা ভয়ে শঙ্কার ডঙ্কা ডাকে মনে।খাদের নীচে চকচকে খোলস ছাড়া সাপের মত তেড়েফুড়ে বয়ে যায় অমরগঙ্গা। নদীর বুক মাঝে মাঝে দেখা মেলে
গ্লেসিয়ার রূপী বরফের।স্রোতস্বিনী জমাট বরফে গহ্বর সৃষ্টি করে প্রবাহ রেখেছে বহাল।নদীর ওপারে পাহাড়কে বেষ্টন করে ঘন নিবিড় বন।পাহাড়ের চুড়া বেশিরভাগ নেড়া।কোনটায় আবার হাল্কা বরফের চিহ্ন।বাঁহাতে সবুজ ঘাসে মোড়া পাহাড় ক্রমশ ডানদিকের পাহাড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আকাশ ছোঁবার চেষ্টায়।পালকের মত হাল্কা সাদা কুয়াশা চোখ-মুখে শীতল প্রশান্তির ছোঁয়া দিয়ে মেঘ হয়ে জমাট বাঁধে আকাশের গায়ে।দু-এক জন ভীষণ সাহসী যাত্রী হাঁটছেন ঘোড়ার ভিড় ঠেলে গুটি-গুটি পায়ে। ঘোড়া থামলে বাড়ছে তাদের হাঁটার গতি।আকাশপথে অনবরত হেলিকপ্টারে পূর্ণাথীদের যাতায়াত।বয়স্ক মানুষ অথবা ঘোড়াতে চাপতে যারা অসাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তারা চলেছেন কান্ডী বা পাল্কীতে। পাঁচ কিমি পথ অতিক্রান্ত।চওড়া বাঁকের মুখে চায়ের দোকানের সামনে ঘোড়া থেকে নেমে প্রাতরাশ।রোদের তাপ ভীষণ তীক্ষ্ণ ।পাশাপাশি দুটি দোকানে উপচে পরা ভিড়।প্রায় মিনিট ত্রিশ বাদে চা আর টোষ্টে পেটপুজো সেরে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার।পথের ভান্ডারাতে দাঁড়ানোর উপায় নেই।চলতি যাত্রীদের ছোট কাগজের প্লেটে তারা পরিবেশন করছেন কলা আর সিদ্ধ ছোলা।এখন সেভাবে চড়াই নেই,বেশ সমতল বলা যেতে পারে।ডানদিকের ঢালে,সবুজ দূর্বার শোভা বাড়াতে ফুটেছে অসংখ্য ছোট ছোট হলুদ ফুল যেন টুইঙ্কিল টুইঙ্কিল লিটিল ষ্টার।জায়গার নাম বারারি।উতরায়ে নামছি।সংগমের কিছুটা আগে ঘোড়া থেকে নামতে হল সবাই কে।এখান থেকে দুটি রাস্তা ভাগ হয়েছে।হেঁটে যাবেন যারা সোজা রাস্তা গিয়েছে গুহার দিকে।এ পথের নাম কালীমাতা।অন্য রাস্তা আমাদের।সেটা প্রথমে নেমেছে তারপর আবার চড়াই ভেঙে সংগম টপে অপেক্ষা,যতক্ষণ না ঘোড়া আসে।এই নামা ওঠার রাস্তাটা ঘোড়া চলবে না।
লাঠি ছাড়া নামাটা বেশ কষ্ট সাধ্য।প্রতি পদক্ষেপে সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে গুঁড়ো পাথরে পা পিছলের ভয়ে।দূরে নদীর সংগমে অনেক মানুষের সমাগম।সেদিকে না গিয়ে পা বাড়ালাম টপের রাস্তায়।উঁচু পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্ণার জলের তীব্রতা থেকে যাত্রীদের সুরক্ষিত রাখতে দুটি লোহার সেতু,ওপরের হেঁটে যাওয়া যাত্রীদের আর নীচে ঘোড়ার যাত্রীদের জন্য।লোহার সেতুতে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সৃষ্টি এবং মানুষের পথ দুয়ের সমন্ময় ভাবনা তারিফ যোগ্য।পাশ দিয়ে বয়ে চলে অমরগঙ্গা। নদীর বরফ ঠান্ডা জল বোতলে ভরে,চড়াই টপকে টপে।এখন অপেক্ষা ঘোড়ার জন্য।
চারপাশে পাহাড় ঘেরা,একখন্ড ঘাসে মোড়া ঢালু জমি।গভীর খাদের নীচ দিয়ে স্রোতস্বিনী অমরগঙ্গা।সামনে এক পাহাড়ের মাথায় সেনা ছাঊনি।বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের,বেষভূষার- ভাষার বিভিন্নতা ধুয়ে মুছে এখন শুধুই যাত্রী। নানা রঙের পোশাক,ঠাট-বাঁটে নাগরিকতার ঝলক-ঝিলিক।সুরেলা শিষের সুর কানে বাজলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি,পাকা ডালিমের মত গায়ের রঙ,গায়ে সাদা জ্যাকেট,মাথা ভরা সদ্য পরা তুষারের মত সাদা ধবধবে চুল এক ভদ্রলোক আপনখেয়ালে অজানা সুর বাজছে শিষে।মুগ্ধ বিষ্ময়ে চেয়ে ছিলাম সেদিকে। শিষের তরঙ্গে কোথাও যেন প্রেমের ঐশ্বরিক সত্তার ‘অহং ত্বয়ি স্নিহ্যামি’স্বীকৃতি।ঘোড়া যাদের আসছে বাবা অমরনাথের জয়ধ্বনি দিতে দিতে চলছে গুহা মন্দিরের পথে।পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক ওনাকে কিছু বলতে উনি ক্র্যাচ নিয়ে উঠে ডুলির দিকে গেলেন এগিয়ে।হাসি-মস্করা,উদ্বিগ্ন
ভোজনের ও আয়োজন।মাথার ওপর কখনো চিকচিকে রোদ,পরক্ষনেই বরফের ঠাণ্ডা হাওয়ার কাটাকুটি খেলা।অপেক্ষার অবসান। ঘোড়া এলো।আবার যাত্রা শুরু।পর্বতমালার সংকীর্ণ পথরেখা ধরে এগিয়ে চলা।পহেলগাঁও এর পথের যাত্রীরা যখন চলতে থাকে আমাদের চলা তখন থামে।শহরের রাস্তাতে যে ভাবে ট্রাফিক কন্ট্রোল হয়,সেই ভাবে কন্ট্রোল হচ্ছে ঘোড়া।নানা স্রোতে ভাসা জীবনে এ নতুন অভিজ্ঞতা।উঁচুতে উঠছি।ঘোড়া পা ফেলছে মানুষের মত সন্তপর্নে।সামনের দুই পা ওপরে,পিছনের পা নীচে।পাথুরে রাস্তায় পা স্লিপ করলে কোনরকমে সামাল দেয়।সহিসের অদ্ভুত চিৎকার-‘হোউস-সাব্বাস,হোউস-সাব্বাস’।পুনরায় ঘোড়া সচল।উৎরায়ে যখন অসমান উচ্চতার পাথুরে সিঁড়িতে নামছে ঘোড়া তখন ‘প্রতি অঙ্গ কাঁদে মোর প্রতি অঙ্গ লাগি’।চোখ বন্ধ করে ইষ্টনাম জপ।ঘোড়া থামল।ধরণীতে পা ফেলে লম্বা শ্বাসে শরীরের স্বস্তি।সংগ্রামদা নাক কান মুলে ‘খুব শিক্ষে দিলে বাবা ঘটকপৃষ্ঠে আর নয়’।
অমরগঙ্গা জল শক্ত বরফ।পেরোতে
হবে।হাঁটতে হাঁটতে বেসুরো গলায় ‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধধধধ…’।মনে বাঁধন পড়লো কিনা বোঝার আগেই আমি পা হল বাঁধন ছাড়া।পঙ্কজদা
আতঙ্কিত স্বরে ‘কেন রে তুই যেথা সেথা পরিস প্রাণে ফাঁদ’। যন্ত্রনা ক্লিষ্ট গলায় ‘ওরে নীলাকাশে
অমন ক’রে
হেসেই থাকে চাঁদ।’সেনা জওয়ান ছুটে এসে আমার হাত ধরে তুলে পার করে দিল বরফের নদী রূপী ঈশ্বরের আস্তো উঠোনটা। তান্ডবের কলঙ্কে সে উঠোনে কাদা কাদা মাখা স্তুপীকৃত ছেঁড়া পরিধেয় কাপড়,প্লাস্টিক,চপ্পল,ব্যাগ,কম্বল আরো অনেক কিছু। ওপরে নতুন করে আবার প্লাস্টিকের কিছু অস্থায়ী দোকান তৈরী যাত্রী
সেবায়।মন বলল বাপু তাড়া কিসের
একটু স্মরণ করো দুর্যোগে প্রাণ হারানো সহযাত্রীর কথা।স্মরণ করো যুগ যুগ ধরে চলে আসা যাত্রায়
অংশ নেওয়া যাত্রীদের কথা যাঁরা ফিরে যেতে পারেনি প্রিয়জনের কাছে।সকলের আত্মার উদ্দেশ্যে প্রণাম ও শান্তি কামনা করে হাঁটা।
সাড়ে তিনটে বাজে সারে-চারটেয় গুহামন্দির দর্শনার্থীদের জন্য হবে বন্ধ। জোর বাড়লো হাঁটায়।গন্তব্য গুলজারের দোকান।বরফের চাঙড়ের ওপর দ্রুত হাঁটার ফল আবার ধপাস।এবার হাঁটুতে চোট।ব্যাথা ব্যকুল করল আমায়।সংগ্রামদা তিরস্কার করতে করতে সোজা করলো টেনে। সহৃদয় যাত্রী ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তার লাঠি বাড়িয়ে দেয় আমার হাতে।এগিয়ে চলুন।সামান্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা।তা হোক,অন্দর উৎসাহে উজ্জ্বল।অচেনা মানুষের মহত্বের মুগ্ধতায় মন ভিজে।গুলজারের দোকানে মোবাইল, ব্যাগ,ক্যামেরা রেখে,পূজার সামগ্রী হাতে,আবার হাঁটা। টেন্টের সামনের সংকীর্ণ রাস্তায় এঁকে বেঁকে গুহামুখে।বাক্যহারা,চোখের দৃষ্টি ঝাপসা। আর্শীবাদী হিম বাতাসে তৃষিত হৃদয় পূর্ণ। গুহার ভিতরে কবুতরের ডানা ঝাপটানো। গুহার মাথার ওপরে আরো হাজার তিন ফুট উঁচু গিরিশিখর।ডানদিকে রুক্ষ পাহাড়ের মাঝে মাঝে বরফের সাজ।১২৭৫৬ ফুট উচ্চতায় ১২০ ফুট দৈর্ঘ,৭৫ফুট উঁচু পবিত্র গুহায় স্বয়ম্ভুর বাসস্থান,যা সিন্ধ-ভ্যালির,অমরনাথ পর্বতে অবস্থিত।গুহার পাশের ঝর্ণা নিশ্চিহ্ন ফ্ল্যাশ ফ্লাডে।
বহুদিনের ভাগ্যের কালো আকাশ ফর্সা
হয়ে বর্ফানি বাবার দুয়ারে।ব্যাবধান মাত্র দুশো সিঁড়ি।সমবেত জয়বাবা
অমরনাথ ধ্বনির সঙ্গে গলা মিলিয়ে সিঁড়ি ভাঙা।কিছুটা যেতেই বসার
জায়গায় বসে জুতো খুলে লাইনে সামিল।যাদের মোবাইল বা
ক্যামেরা আছে জমা করতে হচ্ছে নির্দিষ্ট কাউন্টারে।ও সব ঝামেলা
আগেই চুকিয়ে আসাতে আমরা,এগিয়ে চলি।চেকিং, এরপর ভিড়ের গুঁতোগুঁতি।দড়ি ফেলে নিয়ন্ত্রিত
হচ্ছে মন্দিরে ভিড়।একদল বেরোলে,আরেক দলের প্রবেশাধিকার।
সমবেত মন্ত্র উচ্চারনে গুহা মন্দির পবিত্র আনন্দ।সামনে লোহার রেলিং।এরপর পূজারীদের স্থান।শেষে কাঁচের দেওয়ালের পর বরফের বেদী।বেদীর ওপর আড়াই-তিন ফুটের তুষারলিঙ্গ।আরো দুটি ভীষণ ছোট লিঙ্গ।মাতা পার্বতী এবং সিদ্ধিদাতা গণেশের।অমরনাথ শুধু শিবক্ষেত্র নয় শক্তিপীঠও।সতীর গলা পড়েছিল এখানে।গুহার ছাদ থেকে অনবরত চুঁইয়ে জল পড়ছে টপ টপ করে।শুনলাম প্রায় বারো ফুট মত তুষারলিঙ্গ এই কয়েকদিনে গলে হয়েছেআড়াই-তিন ফুট।জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত গুহামন্দির।আম আদমির দেবতা তিনি।ফ্যাসাদ বাধালো নিজের মন।ভক্তের মনে বিপরীত টান।বিজ্ঞান বলে একে ‘Stalagmite’।অন্দরে বিজ্ঞান আর ঈশ্বরের টানাটানি।সংশয়।অর্বাচীন হলে যা হয়। বেসামাল মন ত্রিশঙ্কু।দর্শনও পূজা সেরে গুহার বাইরে।হাতে প্রসাদী ফুল ও প্রসাদ।
উত্তেজনার অবসান।ফুরফুরে মনে উদয় হল ব্রেকফাস্ট পরে পেটে পড়েনি কিছু। খাইনি! মনে আস্তেই,পেট চোঁচো।ভান্ডারা বা কোন খাবার দোকান নেই,সব ভেসে গিয়েছে দুর্যোগে।এক সাধুবাবার খোঁজ পেলাম,যেখানে খাবার মিলতে পারে।সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাঁদিকের বাঁকে আস্তানা।ওনাকে ভাতের কথা বলতে উনি জানালেন সব্জী শেষ,ভাত আর রাজমা ডাল পাবো।কথায় বলে খিদেতে বাঘেও ঘাস খায় অতএব রাজমা ডাল-ভাতই অমৃত।পেটের আগুন একটু ঠাণ্ডা হতে নজর সাধুর দিকে।চোখ জোড়া ঢুলু ঢুলু,মাথায় জটা,শুনেছি এসব জটার বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে।মুখের বেশীর ভাগ অংশ দাড়িতে ঢাকা।গাঁজার কল্কে ফাটানো টানের পর গলগল ধোঁয়া নির্গমন দুই নাসারন্ধ আর মুখে দিয়ে।বাজখাঁই ‘ব্যোম ভোলে’ ডাকে নাদুস চেহারাতে লাগে কাঁপন।আপন খেয়ালে রাগত গলায় ‘মূর্খের দল প্রকৃতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে চল।প্রকৃতিকে বন্দী করার স্পর্ধা যত দেখাবি তত ধ্বংস হবি। মতলববাজ বুদ্ধিতে যত শান দিবি,ততো বিপদ।তার মেজাজ-মর্জি বুঝে চল তবে নতুন পথ দেখাবে। প্রকৃতিকে জয়!অসম্ভব…হাহাহাহাহা।গূঢ় এ ভাষায় সাড়া দেবার ইচ্ছে থাকলেও সময়ের অভাব।ফেরার বাঁশি বেজেছে মনে।ফিরবো হেঁটে।অন্নদাতা সাধুবাবাকে প্রণাম জানিয়ে দানপাত্রে প্রণামী রেখে ফেরত গুলজারের ক্যাম্পে। গুলজারের কথামত নদীর এপারে কালীমাতা মন্দিরের পথে হাঁটা।ঘড়িতে সময় পাঁচটা।আকাশে গোমরামুখো মেঘ।আসার সময় অমরগঙ্গার একতলার সেতু টপকে পৌঁছেছিলাম সংগম চটি।যেহেতু নদীর অন্যপারে আছি এবার অমরগঙ্গা নেই।আছে সেই বিশাল ঝর্ণার দোতলা সেতু।ঝর্ণার জলের ছাটে ভিজে ভিজে হয় উইন্ড চিটার। মেঘ কেটে যাদুকরী সোনালী গোধুলির আলো লেগে আকাশ নদী পাহাড়ে।না দাঁড়িয়ে উপায় নেই।সবার দৃষ্টি দূরের বরফ মোড়া অলৌকিক সোনার পাহাড়ে। রঙ বদলে ফিকে লাল গাড় লাল হয়ে চলে যায় মেঘের গ্রাসে।সন্ধ্যা হয় জ্বলে ওঠে সোলার আলোবাতি।আলোবাতির নীচে চায়ের দোকানে সাময়িক বিরতি।
সামনে পূর্ণিমা,অলৌকিক চাঁদের নরম আলোয় আকাশ-বাতাস,অরণ্য-পর্বত, নদী-নির্ঝর, মায়াময়।আকাশের নক্ষত্র গুলো নীচে নেমে এসেছে।পথ এবার একটানা উৎরাই।গতিকে নিয়ন্ত্রণ ও পায়ের ওপর চাপ কমানোর জন্য লাঠি এই সময় ভীষণ প্রয়োজন। রাস্তায় মোটামুটি আলোর ব্যবস্থা থাকলেও আলোর ঔজ্বলতা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।রাত সাড়ে-দশটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম ডোমেল।ডোমেলে বাবু আর টিংকু কাশ্মীরাদির জন্য বসে আছে।একসঙ্গে ক্যম্পে ফিরবে।আমরাও বসলাম। বাবু জানালো মনোজ বাবুকে পাওয়া যাচ্ছে না,ফোন বন্ধ। দিদি, টিমের সবচেয়ে সিনিয়ার সদস্য,ঘোড়া না পেয়ে জওয়ান দের সাহায্য নিয়ে আজ রাত কাটাবেন গুহা চত্বরে।কাল উনাকে জওয়ানরা গুহা থেকে ঘোড়াতে উঠিয়ে দেবে।মনোজ বাবুকে নিয়ে সকলে চিন্তিত।সংগ্রামদা জানালো ‘চিন্তার কি আছে? উনাকে রাস্তাতে তো আমরা দেখিনি,সিনিয়ার মানুষ দিদির মত উনি ও কোন ব্যবস্থা করে নেবেন।বাবু জানায় ‘চিন্তাটা ফোনটা বন্ধ বলে’।‘ফোনে চার্জ নেই তাই হয়তো। উনি ঠিক আছেন।উনার বয়স হলেও উনি চটপটে মানুষ ঠিক চলে আসবেন কাল’পঙ্কজদার উত্তর।
নিজেদের আস্তানার দিকে পা বাড়তে ‘কাকাবাবু..কথা ছিল..।’পিছুডাকে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখি অবাঙালি সেই বাকপটিয়সী শ্যামবর্ণা নারী সঙ্গে তার পুরুষ সঙ্গী। মনের বিরক্তি চেপে হাসিমুখে-‘বলুন’।লজ্জাবনত নেত্রে‘সেদিনের ব্যবহারে লজ্জিত আমরা’।‘ঠিক আছে,ওটা এমন কি ব্যাপার’।
পরদিন আমরা দুপুর আড়াইটে নাগাদ রওনা দিলাম শ্রীনগরের উদ্দ্যশ্যে।শোনমার্গে চা বিরতি।চা পর্ব মিটিয়ে এদিক ওদিক ঘুরছি।জে কে পুলিশের ভ্যান থেকে অফিসার মুখ বাড়িয়ে আমাদের গন্তব্য শ্রীনগর শুনে নিদান দিলেন এক্ষুনি যেন আমরা বেরিয়ে যায়।পাঁচটায় মনিগ্রামে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে।পরি কি মরি করে আবার যাত্রা শুরু।বিধি বাম আধাসেনারা রাস্তায় কাঁটাতারের রোল ফেলে আবরূদ্ধ করেছে রাস্তা।ঘড়িতে সময় পাঁচটা তিন। চিৎকার-চেঁচামিচি,যুক্তি-পাল্টা যুক্তি,অনুনয়-বিনয় সব বিফল।অতঃপর রাত্রি যাপন এখানেই।পঙ্কজদা ছুটে এসে খবর দিল ‘চলুন গরম পেল্লায় সাইজের জিলিপি ভাজা চলছে,লাইন লাগায় ভান্ডারাতে।বাবা যখন আটকেছে,মনে হচ্ছে তার কৃপায় আজ রাতে ভালো খাবার ও জুটবে এখানে’।
খুব সকালে বাস ছাড়বে।রাতের খাবার
পর্ব মিটিয়ে ঘুম।খুব সকালে উঠে দেখি হাল্কা স্থির কুয়াসার
আবছা চাদর।মিলিটারি ক্যাম্প এটা। জওয়ানরা মাঠে অভ্যাস করছে তাদের প্যারেড।এক লক্ষ্যে কটা দিন চেনা অচেনা মানুষ,হিমালয়ের জল জঙ্গল নদী আধ্যাত্মিক বাতাসে আনন্দের নিবিড়তায় পরিপূর্ণ হৃদয়।তবু একটা অবুঝ ব্যাকুলতা ঘুরে ঘুরে
আসে।বারবার মনে হয় কি যেন দেখা হলনা।সেটা হয়ত
ছিল অভিজ্ঞতার অভাবে নজরে আসেনি।এ এক অদ্ভুত মধুর
বেদনা।কিছুক্ষণ পড় সব চাপা পরে যাবে জীবিকার টানে।আচ্ছা, জীবন মানেতো শুধু জীবিকা নয়।
একঝাঁক
ছোট ছোট নাম না জানা পাখির কিচিরমিচিরে চোখতুলে ক্ষণিকের চোখাচুখি পরক্ষণেই উধাও।ওদের ভাষা
না বুঝলেও মনে হল আবার এসো,দেখা হবে অন্য কোন
হিমালয়ের প্রান্তরে।
অস্ত্যত্তরস্যাং দিশি দেবতাত্মা হিমালয়ো নাম নগাধিরাজঃ।
পূর্বাপরৌ তোয়নিধীবগাহ্যস্থতঃ পূথিব্যা ইব মানদণ্ডঃ।।