![]() |
গরুর ল্যাজ ধরে বৈতরনী পার করে স্বর্গের দুয়ার |
![]() |
সাগরসঙ্গমে ভক্ত
|
![]() |
সংসারে চোট-হোঁচটে জেরবার মানুষ হাজার কষ্ট সহ্য করে ডুব দিতে আসে সাগর-সঙ্গমে |
ট্রেন এখন লক্ষ্মীকান্তপুর ষ্টেশনে বেশ কিছুক্ষন থামবে,অতএব প্লাটফর্মের মুক্ত বাতাসে পায়চারি,সঙ্গে তিন ফুটে এক গজ চায়ে চুমুক।বৈদুতিক আলোর আলোছায়ায় আধঘুমো,ঝিমোনো প্লাটফর্ম।কেউ বা রাজসিক পালঙ্কে হাত-পা ছড়িয়ে শতছিন্ন কম্বল গায়ে কেউ বা শীতে কুকুরকুন্ডলী পাকিয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে।এও এক রূপ বটে।কত সমাজ সেবক এদের নিয়ে কোটিপতি হল হিসাব কে রাখে।আটপৌরে মানুষ আমি এ সব ভাবা আমার কম্মো না। অতএব তফাত যাও।বুক ফাটুক মুখ ফুটিয়ো না।বাঁশি বাজল ট্রেনের।দাঁড়িয়েছি গেটের সামনে।শহর-শহরতলী-গ্রামকে সচকিত করে এগিয়ে চলছে ট্রেন।গাছপালা গুলো এই ধরা দেয়,এই হারিয়ে যায়।কুয়াশা ঢাকা আকাশে অস্পষ্ট তারা মিট মিট করে জ্বলছে।খোলাগেট দিয়ে হা হা করে ঢুকছে শীতের শির-শিরানী হাওয়া।শূন্য মনে হরেক কিসিম বুদবুদ।চোখ গেল অরিজিৎ আর আবীরের দিকে।আবীর ঝিমোচ্ছে।অরিজিতের দৃষ্টি শূন্য অন্ধকারে। পাশের সহযাত্রী আমায় সাক্ষী মেনে স্বগোক্তি ‘বড্ড ঠাণ্ডা, দরজাটা টেনেদি-’।ভিতর থেকে কণ্ঠ বাজল ‘টেনে আর কি হবে দাদা নিশ্চিন্তপুর পেরিয়ে গিয়েছে আর এক ষ্টেশন বাদেই তো কাকদ্বীপ’।১৯৪৩এ এক ঝড় উঠেছিল কাকদ্বীপে–‘লাঙল যার ফসল তার’শ্লোগানে। ইতিহাসের নাম তেভাগা আন্দোলন।
ট্রেন থামতেই আবার ঝড়।নামুন নামুন স্বরে মাতন উঠল যাত্রীদের।লকগেট খুলে দিলে যে ভাবে হৈ-হৈ করে জলের তোড় নামে সেই ভাবে নেমে এলাম সবাই।আড়মোড়া ভেঙে এবার এগুনোর পালা।ভিনদেশীরা কেউ মাথায়,কেউ কাঁখে,কেউ ঘাড়ে বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে ষ্টেশনের বাইরে চলে গেল।অমলিন ভারতবর্ষ, হাজার কষ্টে ও মুখের হাসি ও দেহের ক্ষমতা লুপ্ত হয় না।অথচ,দন্ত প্রদর্শন সভ্যতায় সবাই দিনের শেষে রেসের ঘোড়া।হেরে যাওয়া যাবে না।হারলে তোমার কোন পদার্থ নেই।সবচেয়ে নিকট বন্ধু মায় বাপ-মা'ও পাশ কাটাবে তোমায়।অনেক ভ্যানতাড়া কষলাম এবার বেরুতে হবে।তিন-চার কিমি গেলে হারউড পয়েন্ট ৮ নম্বর জেটি,সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে নিতে হবে টিকিট।মুড়িগঙ্গায় জোয়ার এলে তবে পাড়ি দিয়ে ও পারে কচুবেড়িয়া।না না শেষ না এখানে, এরপর মোটর গাড়ী করে ত্রিশ কিমি গেলে গঙ্গাসাগর।সাধে কি বলে-‘সব তীর্থ বার বার গঙ্গাসাগর একবার’।যদিও এখন তা বলা যাবে না।একসময় শ্বাপদ সঙ্কুল এই দ্বীপে আসা অনেক টা ছিল অগস্ত্য যাত্রার মত।তীর্থে এলে ফেরবার আশা প্রায় শূন্য।তবু সব উপেক্ষা করে তখনও লক্ষ-লক্ষ যাত্রী এখানে আসতো।আমার কথা নয়,সে সময়ের পত্র-পত্রিকা বলছে।
চা-বিস্কুট
খেয়ে তিনজন রাস্তার দিকে পা বাড়ালাম।দু-পাশে রিজার্ভ বাসের সারি তারই মধ্যে দিয়ে পায়ে
চলা রাস্তা,বাসের নীচে আপাদমস্তক মোড়া ক্লান্ত,ঘুমন্ত, তীর্থযাত্রী পেরিয়ে পিচের
রাস্তা।সে পথে জনসমুদ্রের কলরোল।‘পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ’সার দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রদেশের
পোশাকে।আসাটা কম যাওয়াটাই বেশী।উস্কোখুস্কো,পরিপাটি টেরিকাটা চুল,কারো বা মাথা ন্যাড়া।কাউকে গোঁফ দিয়ে চেন যায় তো,কাউকে ডান দিকে পরা বিচিত্র নথ দিয়ে চেন যায়। দেখে যেন
আশ মেটে না।গলায় সুর গুন গুনিয়ে ওঠে-‘আকাশ ভরা সূর্য তারা/বিশ্বভরা প্রাণ ..’। আবীর হঠাৎ চিমটি কেটে বলে‘খুব হয়েচেএবার ক্ষান্ত দাও দাদা’।পাশ দিয়ে টিং টিং করে ছুটে যাচ্ছে
ভ্যান রিক্সা।আমরাও ভ্যান রিক্সায় সওয়ারী হলাম।গন্তব্য হারউড পয়েন্ট আট নম্বর জেটি।কত মানুষ, কত তার মনের গতি।কোথাও খিলখিল হাসি তো কোথাও যন্ত্রণার চিহ্ন আঁকা মুখ।কোথাও বিবাদ তো কোথাও রিনরিনে গলায় গান।সে গানের ভাষা আমার জানা নেই,তবু মনের ভিতর
খুশী বাজে।এক পথহারা ভিনদেশী উদভ্রান্তের মত এদিক-ওদিক খুঁজে বেড়ায় তার সঙ্গীকে।এক
খঞ্জ পিঠে বোঝা নিয়ে ক্র্যাচে ভর করে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে।ভ্যান রিক্সার বেগ আর শীতের
কুয়াশাতে ঝাপসা হয়ে যায় সব মুখ।কাকদ্বীপের কিছু আগে গঙ্গার দু-ধারা একটা মুড়িগঙ্গা
বা বরতলা নদী ইংরেজী নাম চ্যানেল ক্রীকস, আর এক ধারা গঙ্গা যার সাহেবী নাম হুগলী নদী।
মধ্যে জেগে থাকে গঙ্গাসাগর।
টিকিট নিয়ে ভেসেলে ওঠা।গিজ গিজ করছে মানুষ।চাপা আতঙ্ক দানা বাঁধছে মনে,সলিল সমাধি হবে না তো!তবু ভরসা আমি একা নয়এই জনস্রোতের আমি আর একটা ক্ষুদ্র প্রাণ।ভাসমান ভারতবর্ষ এখন চলেছে কচুবেড়িয়ার দিকে।হঠাৎএক ঝাঁকুনিতে বেসামাল যাত্রী।দিগন্তবিস্তৃত মানুষ আর মানুষ তার সঙ্গে বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন গলার চিৎকার,ছুটোছুটি কে আগে উঠবে গাড়িতে।পরিবেশের গুনে আমরাও তার সঙ্গী।এক সহৃদয় পুলিশ নিয়ম ভেঙে বাসে তুলে দিল আমাদের।মোটামুটি ত্রিশ কিমি রাস্তা।অতএব নিশ্চিন্তে বসে থাকা।জানলা দিয়ে ফুর ফুরে শীতের হাওয়ায় ক্লান্ত শরীর চলে গেল ঘুমের গভীরে।বলে রাখা ভালো যারা নামখানা হয়ে আসবেন তারা দীর্ঘ লঞ্চ যাত্রার পর,চেমাগুড়ি থেকে বাসে ৭ কিমি গেলে পৌঁছে যাবেন গঙ্গাসাগরে।
জনসমুদ্রের
মধ্যে দিয়ে হাঁটা।বৈদুতিক আলো'কে উপেক্ষা করে ভোরের আলো ফুটব ফুটব করছে। প্রকৃতির
এই নিয়ম, কৃত্রিমতা তার নাপসন্দ।বার বার মনে করিয়ে দেয় নিয়ম মেনে থাকো,নইলে রোষে
ধ্বংস হবে।মানুষের লোভ বশ মানাতে যায় প্রকৃতিকে।সবকিছু ছারখার করে প্রতিশোধ নেয় প্রকৃতি।ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের আশ্রমে আগাম অনুমতি পত্র দেখিয়ে ঘর পেলাম দোতলায়।উচ্চগ্রামে
কীর্তন চলছে আশপাশের মাইকে।বিছানায় খানিক উসখুশ করে বেরিয়ে পড়া।আশ্রমে থিক-থিক করছে
যাত্রী।গেটের বাইরে একমুখী জনস্রোত।কারো বা আশ্রয় আছে কেউ বা আশ্রয় নেবে সরকারী বা
বিভিন্ন আশ্রমের প্লাস্টিক বা হোগলার ছাউনিতে।এছাড়াও স্থানীয়রাএই সময় ছাউনি বানিয়ে
বিক্রি করে চড়া দামে।যে রাস্তা দিয়ে এখন হাঁটছি সে রাস্তার দু'দিকে স্থায়ী দোকান আর
সরকারী বিভিন্ন দপ্তরের বাংলো।প্রাচীন ইতিহাস বলে,‘গঙ্গে
বা গঙ্গানগর পূর্বভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ নগরীএবং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যানিজ্যবন্দর।আর
সে নগর ছিল এই্ সাগরদ্বীপ-গঙ্গাসাগর।আর প্রাক গুপ্তযুগ থেকেই সেই মহানগর পূণ্যতম সর্বভারতীয়
তীর্থে পরিণত হয়েছিল’।সেকালের প্রচলিত বাংলা পত্রিকা
‘হরকরা’য় (১৮৩৭খ্রিঃ, ৪ফেব্রুয়ারি)গঙ্গাসাগর মেলা নিয়ে এক প্রবন্ধে লেখা হয়েছে,‘প্রতি বৎসর প্রায় ডিসেম্বর মাসের মধ্য সময়ে অনেক নৌকা ও মাড় সাগর উপদ্বীপের এক টেঁকে একত্র হইতে আরাম্ভ হয়। এই স্থানে যে এক মন্দির আছে তাহা লোকে কহে যে ১৪০০ বছর হইল গ্রথিত হইয়াছে ঐ মন্দিরে কপিল মুনি নামে প্রসিদ্ধ দেবরূপ এক সিদ্ধপুরুষ প্রতিষ্ঠিত আছেন। রামায়ত্ত বৈরাগি ও সন্ন্যাসিরদের মধ্যে অন্যান্য জাতীয়েরা তাঁহাকে অতিপূজ্য করিয়া মানেন। ইঙ্গরেজী ৪৩৭ সালে ঐ মন্দির গ্রথিত হইলে জয়পুর রাজ্যস্থ গুরুসংপ্রদায় কর্তৃক উক্ত সিদ্ধর্ষি প্রতিষ্ঠিত হন’।কথিত ভগীরথ গঙ্গা আনয়নের আগেই শ্বেতদ্বীপের রাজা মাধব বঙ্গোপসাগরের তীরে বিরাট বিষ্ণুর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ও তা ছিল ভারত বিখ্যাত। কিন্তু কোথায় ছিল এই মন্দির সে সম্পর্কে নীরব থাকে ইতিহাস। যদিও‘সমাচার দর্পণ’ (১৮১৯খৃঃ, ৮ জানুয়ারি) বলে ‘ইংরাজি ৪৩০ সালে উক্ত মন্দির(মাধব মন্দির) তৈরি হয়এবং মন্দিরে কপিল মুনি বিগ্রহ স্থাপন হয় ওই সময়ে’।ভবদেব ন্যায়ালঙ্কারের ‘তীর্থসার’ সংস্কৃত পুঁথিতে গঙ্গাসাগর তীর্থের পরিচয়ে -শ্বেত দ্বীপের রাজা মাধব ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাধব মূর্তির কথা ও কপিল মুনির বিগ্রহের কথাও উল্লেখ করেন।ষোড়শ শতকের প্রাচীন পুঁথি ‘তীর্থতত্ত্বপ্রদায়িনীতে’কপিল মুনির মন্দিরের কথা রয়েছে।অন্যমতে আছে- ৪৩০ খ্রিষ্টাব্দে রানি সত্যভামা প্রথম কপিল মুনির মন্দির তৈরি করেন।প্রথম মন্দির ধবংস হবার পরে আবার ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি হয় নতুন মন্দির।এর পরে প্রায় ছ’বার ছ’টি মন্দির বিলীন হয়ে যায় সমূদ্র গর্ভে। বর্তমান মন্দিরটি পুরানো মন্দির থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ইং ১৯৭৩-৭৪ সালে লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে তৈরি করেন অযোধ্যার হনুমানগড়ি মঠের মোহান্ত মহারাজ রামদাসজি।কথিত মেদিনীপুরের রাজা যদুরাম কিছু পশ্চিমি ব্রাহ্মণকে সাগরদ্বীপে এনে ভার দিয়েছিলেন দেখা শোনার। রাজা সগর,ভগীরথ এঁরা সূর্যবংশের রাজা অতএব পরবর্তী প্রজন্ম অযোধ্যা হনুমানগড়ির মহন্ত সীতারাম দাসকেই রাজা যদুরাম পুরোহিত নিযুক্ত করেন।সেই থেকে মন্দিরের মালিক তাঁরাই। অতএব মেলা শেষে প্রনামীর সব অর্থও চলে যায় উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা নগরে। মেলা চত্বরে পাঁচটা গেট যে কোন গেট দিয়ে বেরলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে সঙ্গমের রূপালী তটে।
‘হরকরা’য় (১৮৩৭খ্রিঃ, ৪ফেব্রুয়ারি)গঙ্গাসাগর মেলা নিয়ে এক প্রবন্ধে লেখা হয়েছে,‘প্রতি বৎসর প্রায় ডিসেম্বর মাসের মধ্য সময়ে অনেক নৌকা ও মাড় সাগর উপদ্বীপের এক টেঁকে একত্র হইতে আরাম্ভ হয়। এই স্থানে যে এক মন্দির আছে তাহা লোকে কহে যে ১৪০০ বছর হইল গ্রথিত হইয়াছে ঐ মন্দিরে কপিল মুনি নামে প্রসিদ্ধ দেবরূপ এক সিদ্ধপুরুষ প্রতিষ্ঠিত আছেন। রামায়ত্ত বৈরাগি ও সন্ন্যাসিরদের মধ্যে অন্যান্য জাতীয়েরা তাঁহাকে অতিপূজ্য করিয়া মানেন। ইঙ্গরেজী ৪৩৭ সালে ঐ মন্দির গ্রথিত হইলে জয়পুর রাজ্যস্থ গুরুসংপ্রদায় কর্তৃক উক্ত সিদ্ধর্ষি প্রতিষ্ঠিত হন’।কথিত ভগীরথ গঙ্গা আনয়নের আগেই শ্বেতদ্বীপের রাজা মাধব বঙ্গোপসাগরের তীরে বিরাট বিষ্ণুর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ও তা ছিল ভারত বিখ্যাত। কিন্তু কোথায় ছিল এই মন্দির সে সম্পর্কে নীরব থাকে ইতিহাস। যদিও‘সমাচার দর্পণ’ (১৮১৯খৃঃ, ৮ জানুয়ারি) বলে ‘ইংরাজি ৪৩০ সালে উক্ত মন্দির(মাধব মন্দির) তৈরি হয়এবং মন্দিরে কপিল মুনি বিগ্রহ স্থাপন হয় ওই সময়ে’।ভবদেব ন্যায়ালঙ্কারের ‘তীর্থসার’ সংস্কৃত পুঁথিতে গঙ্গাসাগর তীর্থের পরিচয়ে -শ্বেত দ্বীপের রাজা মাধব ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাধব মূর্তির কথা ও কপিল মুনির বিগ্রহের কথাও উল্লেখ করেন।ষোড়শ শতকের প্রাচীন পুঁথি ‘তীর্থতত্ত্বপ্রদায়িনীতে’কপিল মুনির মন্দিরের কথা রয়েছে।অন্যমতে আছে- ৪৩০ খ্রিষ্টাব্দে রানি সত্যভামা প্রথম কপিল মুনির মন্দির তৈরি করেন।প্রথম মন্দির ধবংস হবার পরে আবার ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি হয় নতুন মন্দির।এর পরে প্রায় ছ’বার ছ’টি মন্দির বিলীন হয়ে যায় সমূদ্র গর্ভে। বর্তমান মন্দিরটি পুরানো মন্দির থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ইং ১৯৭৩-৭৪ সালে লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে তৈরি করেন অযোধ্যার হনুমানগড়ি মঠের মোহান্ত মহারাজ রামদাসজি।কথিত মেদিনীপুরের রাজা যদুরাম কিছু পশ্চিমি ব্রাহ্মণকে সাগরদ্বীপে এনে ভার দিয়েছিলেন দেখা শোনার। রাজা সগর,ভগীরথ এঁরা সূর্যবংশের রাজা অতএব পরবর্তী প্রজন্ম অযোধ্যা হনুমানগড়ির মহন্ত সীতারাম দাসকেই রাজা যদুরাম পুরোহিত নিযুক্ত করেন।সেই থেকে মন্দিরের মালিক তাঁরাই। অতএব মেলা শেষে প্রনামীর সব অর্থও চলে যায় উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যা নগরে। মেলা চত্বরে পাঁচটা গেট যে কোন গেট দিয়ে বেরলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে সঙ্গমের রূপালী তটে।
মেলা ছাড়িয়ে সাগরের জলের ধার দিয়ে হাঁটা,ছোট ছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাড়ে।অনেক পূণ্যার্থীর স্নান হয়ে গিয়েছে, কেউ স্নান শেষে প্রণাম করছেন সূর্যদেবকে, কেউবা স্নানের জন্য নামছেন জলে। বাতাসে আওয়াজ তুলে ভিজে কাপড় শুকোচ্ছে অনেকে।মাইকে অনর্গল সাবধান বাণীর সঙ্গে তীর্থযাত্রীদের কলরবে মেতে উঠেছে মেলা।শীতের কুয়াশা ঢাকা মিঠে রোদ জলে ঝিলিক খেয়ে ছিটকে পড়ছে সাদা বালুচরে।স্নানান্তে শীতার্ত ঠকঠক করে কাঁপা মানুষ সূর্যের উষ্ণ আলিঙ্গনে গরম করে
নিচ্ছে শরীর।স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের সেরা তীর্থ গঙ্গাসাগর।কথিত, মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে দেবর্ষি নারদ গঙ্গাসাগর তীর্থের মাহাত্ম্য কীর্ত্তনে বলেন,গঙ্গাসাগরে স্নানে অর্জন হয় দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান পুণ্য।দেবপ্রয়াগে গোমুখ থেকে ভাগীরথী,বদ্রীনাথ থেকে অলকানন্দা,কেদারনাথ থেকে মন্দাকিনী মিলনে গঙ্গা নেমে আসে হরিদ্বারের সমতলে।দক্ষিণবাহী গঙ্গা এরপর মোরাদাবাদ,সাহারানপুর, মুজফ্ফরনগর,কানপুর আরো অনেক জেলা-শহর-গঞ্জের মধ্যে দিয়ে এসে প্রয়াগ।এখনে উত্তরবাহী গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীকে সঙ্গী করে কিছু দূর এগিয়ে গোমতী,ঘর্ঘরকে নিজের প্রবাহে মিশিয়ে বারানসী পৌঁছে বরুনা আর অসি নদীকে নিয়ে গঙ্গা হল পূর্ববাহিনী।বিহারে ঢুকে কর্ণালী, রাপ্তী, গন্ডক,বাগমতী,কোশী আর শোন নদীর জল লীন হল গঙ্গায়।এরপর রাজমহল পাহাড় ডিঙিয়ে দু'ভাগে ভাগ হয়ে ঢুকলো বাংলায়।একভাগ বাংলাদেশে পদ্মা নাম নিয়ে আর একটা ভাগ পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গা (কেতাবী নাম হুগলী/ভাগীরথী) নাম নিয়ে গঙ্গাসাগরে এসে মিশে গেল নোনা বঙ্গোপসাগরে।প্রেম-ভক্তি,কামনা-বাসনা,ত্যাগ-তিতিক্ষা,আশা-নিরাশার এ এক মিলন ভুমি।অনেকটা ছয় রাগ আর ছত্রিশ রাগিনীর মত যা দিয়ে গাওয়া যায় প্রেম-ভক্তি-ভালবাসা-বিরহের সব গান।
আমরা চলেছি কপিল মুনির মন্দিরের দিকে। কাল ও পথে যেতে গেলে শরীরে বল লাগবে।আজ তুলনামূলক ভিড় কম।নিতান্ত সাদামাটা মন্দির,ইতিহাস বলে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত যে মন্দিরের অস্তিত্ব তা ছিল প্রশস্থ এবং উড়িষ্যা থেকে আনা শঙ্খ পাথরে তৈরী সে মন্দির ছিল স্থাপত্যকলার বিখ্যাত নিদর্শন।সেইসময় মন্দিরে শিব ও কপিল মুনি পূজিত হতেন।এরপর সে মন্দির সমুদ্রের গর্ভে গেলে সৈকতের ওপর এক বটগাছের কাছে বালি,মাটি আর বাঁশ-খড় দিয়ে তৈরী হত অস্থায়ী মন্দির।কপিলমুনির পূজা শেষে,পূণ্যার্থীরা
বটগাছের নীচে থাকা রামচন্দ্র ও হনুমান মূর্তির পূজা করতেন এবং নিজেদের মনের কামনা-বাসনা জানিয়ে সুতোয় ঢিল বেঁধে ঝুলিয়ে দিতেন বটগাছে।সঙ্গে থাকতো মনস্কামনা পূরণ হলে এ পথের দূর্গমতার জন্য অন্য কোন দেবস্থানে পূজার প্রতিশ্রুতি।বর্তমান মন্দিরের ভিতরে বাঁদিক থেকে প্রথম মকরবাহিনী গঙ্গা সামনে ভগীরথ,ডানদিকে কপিলমুনি তারপর সগর রাজার মেটে সিঁদুর রঙের মূর্তি।ভক্তদের হাতে পূজার ডালা, উৎসুক কোন ভক্ত পয়সা ছুঁড়ে দিচ্ছে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে,ভাবটা এমন-এই নাও পয়সা আর পাকা কর আমার মোক্ষ।ভিতরে আঁকুপাঁকু করা বিদ্রূপটা নিস্তেজ হয়ে বলে বাপু ধর্মে থাকো।মহামানব তো নই,অতএব শরিক হয়ে যাই চলমান মানুষের ধারায়।লৌকিক হিন্দু ধর্মের এও এক রূপ।
মন্দির
থেকে বেরিয়ে নাগা সন্ন্যাসীদের খুপরি ঘর।ভক্তকুলকে দেদার আর্শীবাদ বিলোচ্ছে দশ,পঞ্চাশ,একশো টাকার বিনিময়ে,না পেলে হিন্দিতে মন্দ কথার স্রোত।লক্ষ মন,লক্ষ বাসনা।
অরিজিৎ
বলে এরা নিশ্চয় ‘কারোবারী’ সাধু।চোখের কৌতূহল দেখে আরো জানাল পূর্ণ-কুম্ভে নির্বাচিত হয় নাগা সাধুদের বিভিন্ন আখড়ার মহন্ত (প্রধান),পুজারী, কারোবারী(ট্রেজারার), কোতোয়ালী(রক্ষক) এইসব বিভিন্ন পদ।আবীর ক্যামেরা বন্দী করছে বিভিন্ন সাধুদের খন্ড মূহূর্ত। হঠাৎ এক সাধু ক্যামেরা তাক করে ছুঁড়ে দিল জল।কারণ জিঞ্জাসা তে রূঢ় ভাষায় উত্তর, ছবি তোলার জন্য দিতে হবে প্রনামী।সবাই সুখ চায়,সন্ন্যাসীই বা ব্যতিক্রম হবে কেন?কথা না বাড়িয়ে নজর পড়ল উল্টো দিকের খুপরিতে ধ্যানস্থ এক বৃদ্ধ সাধুর দিকে।নিভু নিভু যজ্ঞের আগুন,প্রশান্ত মুখে মৃদু হাসির রেখা,সামনে পরে আছে কিছু টাকা।কোন কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ নেই ওনার।যার যেমন জীবন সে চলে তেমন চালে।দশ টাকা সামনে রেখে প্রণাম জানিয়ে এগিয়ে গেলাম।
গেট দিয়ে বেরিয়ে আবার নেমে এলাম সাগর তটে।দৃষ্টি দূরের ঝাউ গাছের ঢাকা বালিয়াড়ি।‘সূর্য বংশের রাজা সগরের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গভ্রষ্ট হবার ভয়ে বেঁধে রাখে কপিলমুনির আশ্রমে।এদিকে ঘোড়া না পেলে শুরু করা যাবেনা যজ্ঞ।পিতার হুকুমে রানী প্রভা’র ৬০০০০ পুত্র বেড়িয়ে পরে ঘোড়ার খোঁজে।আরেক রানী ভানুমতী’র পুত্র অসমঞ্জ থাকল রাজপ্রাসাদে।খুঁজতে-খুঁজতে ঘোড়া পাওয়া গেল কপিল মুনির আশ্রমে।ক্রদ্ধ রাজপুত্রদের অপমানে ভঙ্গ হল মুনিরধ্যান।ঋষির রোষানলে ভষ্মে পরিণত হল ৬০০০০ পুত্র।যজ্ঞ রইল অসমাপ্ত।অসমঞ্জ পুত্র অংশুমান জ্যেষ্ঠতাতদের খোঁজে উপস্থিত হল মুনির কাছে।কপিল মুনি অংশুমানের স্তবে খুশি হয়ে বর দেন দুটি।প্রথম বরে যজ্ঞাশ্ব ফেরত ও দ্বিতীয় বরে জ্যেষ্ঠতাতদের মুক্তি চাইলে,মুনি প্রথমটি মজ্ঞুর করে যজ্ঞাশ্ব ফেরৎ করেন এবং দ্বিতীয়টির জন্য তাঁদেরকে শর্ত দেন যদি স্বর্গ থেকে গঙ্গা এসে তাঁদের জ্যেষ্ঠতাতদের অভিষিক্ত করে তবেই শাপমুক্তি ঘটবে।অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পূর্ণ করে সগর রাজা অংশুমানকে রাজ্যভার দিয়ে বনবাসী হলেন।শুরু হল গঙ্গাকে মর্তলোকে আনবার সাধনা।অংশুমান,তাঁর পুত্র দিলীপ অবশেষে দিলীপের পুত্র ভগীরথ তুষ্ট করেন দেবী গঙ্গাকে।মুক্তি পায় সগর রাজের সন্তানরা।আর এই তীর্থভূমি হল গঙ্গাসাগর’।এক নিঃশ্বাসে গল্পটা শেষ করে আবীর ছুটল
বয়সের ভারে ন্যুব্জ,ঝুলে পরা মুখে অজস্র বলিরেখা এক বৃদ্ধার ছবি তুলতে।আমরাও পিছু নিলাম।পরিচয় হল নদীয়া নিবাসী শুকদেব বাবুর সঙ্গে।দৃষ্টি উপচানো পরিতৃপ্তি নিয়ে বললেন-‘৯৮ বছরের মাকে নিয়ে এসেছেন মকর সংক্রান্তির পূর্ণ্যস্নানের জন্য।সঙ্গে অবশ্য পাড়া-প্রতিবেশীরাও আছেন’।কথা বলতে বলতে আমরা পৌঁছে গেছি,হোগলা-প্লাস্টিকে তৈরী ঝাউবনের ভিতর তাদের অস্থায়ী সংসারে।পাশাপাশি সব আস্তানাই একই রকম।সবারই কাঠের জ্বালে রান্না চলছে।হঠাৎ খ্যার-খেরে কর্কশ বামাকণ্ঠ ‘তবে রে মরাখাকী ফের এসেছিস’।রে রে করে আরও কিছু ঘোমটা খসা বৌ তেড়ে গেল খড়ি ফোটা আদুল গায়ের শীর্ণ ৬-৭ বয়সের মেয়েটির দিকে।জিজ্ঞাসা তে জানলাম মেয়েটি নাকি খাবার সময় লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।নজরও খুব খারাপ।খিদের কলঙ্ক নিয়ে ছুট লাগালো মেয়েটি।এসব ঘটনা প্রায় সবারি স্মৃতিতে থাকে মুখস্ত।প্রথমদিকে মনে আলোড়ন তুলত এখন অভ্যাস গুনে এসব আলোড়ন সহজে যায় ঝিমিয়ে।ফেরৎ আসি আমাদের ডেরা ভারত সেবাশ্রমে।অরিজিৎ বলে রামায়ণের আদিকান্ডে আছে হিমালয় ও মেনকার পুত্রী গঙ্গাকে হিমালয়ের কাছ থেকে দেবতারা নিয়ে আসে শিবের সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্য।আদরের মেয়েকে দেখতে না পেয়ে অভিশাপ দেন মেনকা,যার ফলে জল হয়ে ব্রহ্মার কমন্ডলুতে স্থান পায় গঙ্গা।ভগীরথ পূর্বপুরুষের মুক্তির জন্য গঙ্গাকে মর্তে নিয়ে আসেন রামায়ণের যুগে।
সন্ধ্যার দিকে আবার আমরা নেমে এলাম সাগর-সঙ্গমে ।থিক-থিক মানুষের ভিড়।কাল খুব ভোরে পূর্ণ্যস্নান।বালির ওপর কেউ পলিথিন কাগজ বিছিয়ে,কেউ খড় বিছিয়ে কাঁথা-কম্বল গায়ে গুটিসুটি মেরে শীতের কনকনে বাতাস উপেক্ষা করে পড়ে আছে খোলা আকাশের নীচে।অস্থায়ী শৌচাগারের উপচে পরা জলজ অংশ মিশছে সাগরের জলে।জোয়ারের জন্য জলের তরঙ্গ ক্রমশ গ্রাস করছে স্থলের বালিয়াড়িকে।জল সরলে আলোতে অভ্রের মত চিকচিক করছে সাদা বালি।অনেকে গঙ্গার সন্ধ্যা-আরতিতে রত
ধুপ-প্রদীপ-মোমবাতি দিয়ে।বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীর দল খোল-করতাল সঙ্গে কৃষ্ণনাম করে মাধুকরী করছে।মাইকে বাজছে ‘ও মা পতিত পাবনি গঙ্গে..’।ঘূর্ণায়মান সাদা সার্চ লাইট চকিত করছে মানুষজনকে। সারা মেলায় আলোর বন্যা।বালির চরেই কাঠের জ্বালে রান্না চলছে সেইসঙ্গে গল্পগুজব।কয়েকজন দেহাতি মানুষ সুর করে গাইছে-‘তুম হি নীক লাগৈ রঘুরাই/সো মোহি দেহু দাস সুখ দাই’(হে রঘুপতি,দাসের সুখের বিধান তোমার লীলা,তোমার যা অভিরুচি,তাই তুমি আমাকে দাও)।আনন্দশূন্য অভ্যাসে বেঁচে থাকা একই মানুষ রোজকার জীবনের ভাঙ্গাগড়া ভুলে পরিবেশগুণে অসংখ্য রূপে মেলে ধরেছে প্রানের উল্লাসের অনন্ত ঐশ্বর্যকে।পূর্ব দিক বরাবর কিছুটা হাঁটতে ভিড় পাতলা হয়ে আসে।দূরে শ্মশানে দাউ দাউ করে জ্বলছে তিনটে চিতা।কানে আসে –‘গুরু বলে কারে প্রণাম করবি মন?/ তোর অষিক গুরু,পথিক গুরু,গুরু অগনন/কারে প্রণাম করবি মন?’পাতলা হাল্কা কুয়াসার অন্ধকারে,সাদা পোশাকে একতারা হাতে গুনগুন করে গান শোনাচ্ছেন মা গঙ্গাকে।গানের আবেগে আমাদের বেগ রূদ্ধ।ফোঁপানো কান্নার শব্দে ছেদ পরে তন্ময়তায়।কান্নার সুরে,বহু দিনের জমানো ভালবাসা চিতার
আগুনে বিগলিত হয়ে ঝরছে।কেউ নেই যাকে বৃদ্ধা তার বেদনার ভাগ দিতে পারে।গলার কাছে কিছু একটা ঠেলে উঠতে চাইলেও বেরুতে পারছে না।নির্বিকার,নিরাসক্ত, নিরপেক্ষ সাক্ষী হয়ে স্যাঁতসেতে মনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সবাই।গায়ক এগিয়ে আসে।সাদা দাড়ির খাঁজে কৌতুক মেশানো হাসি –‘সংসার,সং সরতি যা ক্রমশ সরে যায়,না মানতে পারলে কষ্ট হবে বইকি বাবা’।
খুব ভোরে,অন্ধকারের খোঁয়ারি তখনও কাটেনি,আমরা নেমে এসেছি সাগরের ধুসর বেলাভুমিতে।শির শিরানি হাওয়ায় কুয়াসা মোড়া পৌষের থিরথির করা পাতলা আলোয় অসংখ্য মানুষের মিলিত
পূণ্যস্নান।সমবেত কথোপকথন,শঙ্খ,শিঙা,খোল-করতালের বিচিত্র সুর ভাসছে বাতাসে।হাওয়ায় ওড়ে নারীর আলুলায়িত সিক্ত কেশরাশি।সাইকেলের পিছনে বাঁধা তুলসী গাছে স্নানন্তে পূজা।শ্রাদ্ধ-শান্তি-পিন্ড দান এমন কি তিলক কেটে গায়ে জামা,গলায় ফুলের মালা,পরে গরুও হাজির,যাতে ভক্ত গরুর ল্যাজ ধরে বৈতরণী পার হতে পারে।বিনিময়ে গরুর মালিকের প্রাপ্য কিছু দক্ষিণা।বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর চারিদিকে সজাগ দৃষ্টি।নজরদারি চলছে ড্রোন উড়িয়ে।নতুন এক জগতে,বিচিত্র যজ্ঞক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আমরা।ভক্তকুলের আকুতির মুর্ছনায় পূর্ব দিগন্তে রঙের ছোপ লেগেছে।দিন জাগছে,জেগে উঠেছে মেলাও।রাঙা আভায় প্লাবিত চরাচর।ছোটছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাড়ে,ফিরতি পথে ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে
পুণ্যার্থীদের দেওয়া পূজা সামগ্রী।স্থানীয় মানুষ সে সব জল থেকে তুলে চালান করে দিচ্ছে পাড়ে বসা ব্যাবসায়ীর কাছে,বিনিময়ে মিলছে পারিশ্রমিক।চোখের সামনে বিরামহীন বিভিন্ন চরিত্রের আনাগোনা‘নানা ভাষা .. নানা পরিধান’এ।প্রচুর ফটোগ্রাফার ফটো তুলছে বিশেষ মূহুর্তের।সে দলে কিছু গোরা সাহেব মেম ও আছে।হঠাৎ মোটা গলায় চিৎকার-‘এবার থামো দিকিনি বাপু,তীর্থেএসে সারাক্ষন শুধু কিচ-কিচ’।চোখ ঘুরিয়ে দেখি আষ্টেপিষ্টে কম্বল জড়ানো মাঝবয়সী পুরুষ দুহাতে দুই মহিলার হাত ধরে এগিয়ে আসছে।একজন হয়ত স্ত্রী,আরেকজন মা হবেন।বহুরূপী শিবের সাজে জলের কিনারা বরাবর হাঁটতে হাঁটতে সংগ্রহ করছে পূর্ণাথীদের দান।হঠাৎ হৈ-চৈ পরে গেল।কিছু মানুষ ভীষন তৎপর হয়ে
হাতে হাত লাগিয়ে রচনা করল মানব শৃঙ্খল।পুলিশ, চিত্র সাংবাদিকদের হুলুস্থুল।হয়ত কোন মন্ত্রী-সান্ত্রী মোক্ষলাভের জন্য সাঙ্গপাঙ্গো নিয়ে আসবেন।কৌতুহলী প্রশ্নে জানলাম আমার ভাবনা ভুল।পুরীর শঙ্করাচার্য স্বামী নিশ্চলানন্দ আসছেন স্নানে।কচি-কাঁচা ছাড়াও বহু মানুষ সমুদ্র স্নানের আনন্দে মশগুল।স্মার্ট ফোনে অনেকে তুলেছে সেলফি।শিশুকে আঁজলা করে জল তুলে স্নান করানো দেখে গায়ে পড়ে এক
পাখ-পাখালী জাগার আগেই নেমেছি সাগর তটে।মাথায় রোদের তেজ,পেটে খিদের তেজ।তট ছেড়ে এগোলাম খাবার খোঁজে।গরম লুচির গন্ধে খিদেয় কাতর জিভের জল চুঁইয়ে ভিজিয়ে দেয় মুখ।লুচি, খোসা না ছাড়ানো আলুর তরকারী সঙ্গে চা খেয়ে তিনজনের হাঁটা বাসস্ট্যান্ডের দিকে। অনেকে কাঁখে, মাথায়,ঘাড়ে বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে বাসস্ট্যান্ড মুখো।মেলা ভাঙছে।সবার পায়ে-পায়ে ওঠা মেলার ধুলোয় তাদের জামা কাপড় ধুলামলিন।পোষাকের চাকচিক্যে পিছিয়ে থাকলেও প্রাণের ওজনের চমক ধরা পড়ে তাদের চোখের ভাষায় মুখের হাসিতে।কেউ কেউ ভিড় করে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কিনছে কাঁচের চুড়ি,চুলের ফিতে,নানা রঙের কপালের টিপ আরো অনেক সস্তা প্রসাধনী।বাসস্ট্যান্ডে ফিরতি মানুষের গিজগিজানি।বাসের এক কর্মী জানালেন খুব ভোর ভোর এলে আমাদের বসার আসন মিলবে।আবীরের কথায় আবার ফিরে এলাম সাগর তটে।জোয়ার এসে,ডাঙা হয়েছে ছোট। পূণ্যার্থী বেড়েছে।ভিড় ঠেলে কিছুটাএগিয়ে,রণে ভঙ্গ দিয়ে ফেরার পথ ধরা।খিচুড়ি আর মহোৎসবের প্রাণের গন্ধে ম ম করছে ভারত সেবাশ্রমের প্রান্তর।
আগামিকাল আমরা খুব ভোরে চেমাগুড়ি হয়ে নামখানা থেকে ট্রেন ধরব।ক্লান্ত,কেউ আর বেরোতে চাইল না।একা এসে দাঁড়ালাম বালুতটে।নিশ্চল মেঘে তারাদের মিটমিটে আলো।বাতাসের বেগে কাঁপন ধরানো শীতলতা।উছলে পড়া আনন্দ নিভে গিয়ে সঙ্গমতট শ্রান্ত অবসন্ন।কালো সাগরের জল জেগে উঠে বিষন্নতায় ভেঙে পড়ছে পাড়ে।স্তব্ধ মনে বাজে,বাপু হে সন্দেহ করে জেতার চেয়ে বিশ্বাসের কাছে হেরে দেখো না কেমন লাগে।খুব ধীরে নীরব অন্ধকারের অন্তরালে জলে নেমে প্রার্থনা করি –হে পরলোকের আত্মীয়-অনাত্মীয় সকলে আপনারা মুক্ত হোন।
বলে এরা নিশ্চয় ‘কারোবারী’ সাধু।চোখের কৌতূহল দেখে আরো জানাল পূর্ণ-কুম্ভে নির্বাচিত হয় নাগা সাধুদের বিভিন্ন আখড়ার মহন্ত (প্রধান),পুজারী, কারোবারী(ট্রেজারার), কোতোয়ালী(রক্ষক) এইসব বিভিন্ন পদ।আবীর ক্যামেরা বন্দী করছে বিভিন্ন সাধুদের খন্ড মূহূর্ত। হঠাৎ এক সাধু ক্যামেরা তাক করে ছুঁড়ে দিল জল।কারণ জিঞ্জাসা তে রূঢ় ভাষায় উত্তর, ছবি তোলার জন্য দিতে হবে প্রনামী।সবাই সুখ চায়,সন্ন্যাসীই বা ব্যতিক্রম হবে কেন?কথা না বাড়িয়ে নজর পড়ল উল্টো দিকের খুপরিতে ধ্যানস্থ এক বৃদ্ধ সাধুর দিকে।নিভু নিভু যজ্ঞের আগুন,প্রশান্ত মুখে মৃদু হাসির রেখা,সামনে পরে আছে কিছু টাকা।কোন কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ নেই ওনার।যার যেমন জীবন সে চলে তেমন চালে।দশ টাকা সামনে রেখে প্রণাম জানিয়ে এগিয়ে গেলাম।
গেট দিয়ে বেরিয়ে আবার নেমে এলাম সাগর তটে।দৃষ্টি দূরের ঝাউ গাছের ঢাকা বালিয়াড়ি।‘সূর্য বংশের রাজা সগরের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গভ্রষ্ট হবার ভয়ে বেঁধে রাখে কপিলমুনির আশ্রমে।এদিকে ঘোড়া না পেলে শুরু করা যাবেনা যজ্ঞ।পিতার হুকুমে রানী প্রভা’র ৬০০০০ পুত্র বেড়িয়ে পরে ঘোড়ার খোঁজে।আরেক রানী ভানুমতী’র পুত্র অসমঞ্জ থাকল রাজপ্রাসাদে।খুঁজতে-খুঁজতে ঘোড়া পাওয়া গেল কপিল মুনির আশ্রমে।ক্রদ্ধ রাজপুত্রদের অপমানে ভঙ্গ হল মুনিরধ্যান।ঋষির রোষানলে ভষ্মে পরিণত হল ৬০০০০ পুত্র।যজ্ঞ রইল অসমাপ্ত।অসমঞ্জ পুত্র অংশুমান জ্যেষ্ঠতাতদের খোঁজে উপস্থিত হল মুনির কাছে।কপিল মুনি অংশুমানের স্তবে খুশি হয়ে বর দেন দুটি।প্রথম বরে যজ্ঞাশ্ব ফেরত ও দ্বিতীয় বরে জ্যেষ্ঠতাতদের মুক্তি চাইলে,মুনি প্রথমটি মজ্ঞুর করে যজ্ঞাশ্ব ফেরৎ করেন এবং দ্বিতীয়টির জন্য তাঁদেরকে শর্ত দেন যদি স্বর্গ থেকে গঙ্গা এসে তাঁদের জ্যেষ্ঠতাতদের অভিষিক্ত করে তবেই শাপমুক্তি ঘটবে।অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পূর্ণ করে সগর রাজা অংশুমানকে রাজ্যভার দিয়ে বনবাসী হলেন।শুরু হল গঙ্গাকে মর্তলোকে আনবার সাধনা।অংশুমান,তাঁর পুত্র দিলীপ অবশেষে দিলীপের পুত্র ভগীরথ তুষ্ট করেন দেবী গঙ্গাকে।মুক্তি পায় সগর রাজের সন্তানরা।আর এই তীর্থভূমি হল গঙ্গাসাগর’।এক নিঃশ্বাসে গল্পটা শেষ করে আবীর ছুটল
বয়সের ভারে ন্যুব্জ,ঝুলে পরা মুখে অজস্র বলিরেখা এক বৃদ্ধার ছবি তুলতে।আমরাও পিছু নিলাম।পরিচয় হল নদীয়া নিবাসী শুকদেব বাবুর সঙ্গে।দৃষ্টি উপচানো পরিতৃপ্তি নিয়ে বললেন-‘৯৮ বছরের মাকে নিয়ে এসেছেন মকর সংক্রান্তির পূর্ণ্যস্নানের জন্য।সঙ্গে অবশ্য পাড়া-প্রতিবেশীরাও আছেন’।কথা বলতে বলতে আমরা পৌঁছে গেছি,হোগলা-প্লাস্টিকে তৈরী ঝাউবনের ভিতর তাদের অস্থায়ী সংসারে।পাশাপাশি সব আস্তানাই একই রকম।সবারই কাঠের জ্বালে রান্না চলছে।হঠাৎ খ্যার-খেরে কর্কশ বামাকণ্ঠ ‘তবে রে মরাখাকী ফের এসেছিস’।রে রে করে আরও কিছু ঘোমটা খসা বৌ তেড়ে গেল খড়ি ফোটা আদুল গায়ের শীর্ণ ৬-৭ বয়সের মেয়েটির দিকে।জিজ্ঞাসা তে জানলাম মেয়েটি নাকি খাবার সময় লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।নজরও খুব খারাপ।খিদের কলঙ্ক নিয়ে ছুট লাগালো মেয়েটি।এসব ঘটনা প্রায় সবারি স্মৃতিতে থাকে মুখস্ত।প্রথমদিকে মনে আলোড়ন তুলত এখন অভ্যাস গুনে এসব আলোড়ন সহজে যায় ঝিমিয়ে।ফেরৎ আসি আমাদের ডেরা ভারত সেবাশ্রমে।অরিজিৎ বলে রামায়ণের আদিকান্ডে আছে হিমালয় ও মেনকার পুত্রী গঙ্গাকে হিমালয়ের কাছ থেকে দেবতারা নিয়ে আসে শিবের সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্য।আদরের মেয়েকে দেখতে না পেয়ে অভিশাপ দেন মেনকা,যার ফলে জল হয়ে ব্রহ্মার কমন্ডলুতে স্থান পায় গঙ্গা।ভগীরথ পূর্বপুরুষের মুক্তির জন্য গঙ্গাকে মর্তে নিয়ে আসেন রামায়ণের যুগে।
সন্ধ্যার দিকে আবার আমরা নেমে এলাম সাগর-সঙ্গমে ।থিক-থিক মানুষের ভিড়।কাল খুব ভোরে পূর্ণ্যস্নান।বালির ওপর কেউ পলিথিন কাগজ বিছিয়ে,কেউ খড় বিছিয়ে কাঁথা-কম্বল গায়ে গুটিসুটি মেরে শীতের কনকনে বাতাস উপেক্ষা করে পড়ে আছে খোলা আকাশের নীচে।অস্থায়ী শৌচাগারের উপচে পরা জলজ অংশ মিশছে সাগরের জলে।জোয়ারের জন্য জলের তরঙ্গ ক্রমশ গ্রাস করছে স্থলের বালিয়াড়িকে।জল সরলে আলোতে অভ্রের মত চিকচিক করছে সাদা বালি।অনেকে গঙ্গার সন্ধ্যা-আরতিতে রত
ধুপ-প্রদীপ-মোমবাতি দিয়ে।বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীর দল খোল-করতাল সঙ্গে কৃষ্ণনাম করে মাধুকরী করছে।মাইকে বাজছে ‘ও মা পতিত পাবনি গঙ্গে..’।ঘূর্ণায়মান সাদা সার্চ লাইট চকিত করছে মানুষজনকে। সারা মেলায় আলোর বন্যা।বালির চরেই কাঠের জ্বালে রান্না চলছে সেইসঙ্গে গল্পগুজব।কয়েকজন দেহাতি মানুষ সুর করে গাইছে-‘তুম হি নীক লাগৈ রঘুরাই/সো মোহি দেহু দাস সুখ দাই’(হে রঘুপতি,দাসের সুখের বিধান তোমার লীলা,তোমার যা অভিরুচি,তাই তুমি আমাকে দাও)।আনন্দশূন্য অভ্যাসে বেঁচে থাকা একই মানুষ রোজকার জীবনের ভাঙ্গাগড়া ভুলে পরিবেশগুণে অসংখ্য রূপে মেলে ধরেছে প্রানের উল্লাসের অনন্ত ঐশ্বর্যকে।পূর্ব দিক বরাবর কিছুটা হাঁটতে ভিড় পাতলা হয়ে আসে।দূরে শ্মশানে দাউ দাউ করে জ্বলছে তিনটে চিতা।কানে আসে –‘গুরু বলে কারে প্রণাম করবি মন?/ তোর অষিক গুরু,পথিক গুরু,গুরু অগনন/কারে প্রণাম করবি মন?’পাতলা হাল্কা কুয়াসার অন্ধকারে,সাদা পোশাকে একতারা হাতে গুনগুন করে গান শোনাচ্ছেন মা গঙ্গাকে।গানের আবেগে আমাদের বেগ রূদ্ধ।ফোঁপানো কান্নার শব্দে ছেদ পরে তন্ময়তায়।কান্নার সুরে,বহু দিনের জমানো ভালবাসা চিতার
আগুনে বিগলিত হয়ে ঝরছে।কেউ নেই যাকে বৃদ্ধা তার বেদনার ভাগ দিতে পারে।গলার কাছে কিছু একটা ঠেলে উঠতে চাইলেও বেরুতে পারছে না।নির্বিকার,নিরাসক্ত, নিরপেক্ষ সাক্ষী হয়ে স্যাঁতসেতে মনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সবাই।গায়ক এগিয়ে আসে।সাদা দাড়ির খাঁজে কৌতুক মেশানো হাসি –‘সংসার,সং সরতি যা ক্রমশ সরে যায়,না মানতে পারলে কষ্ট হবে বইকি বাবা’।
খুব ভোরে,অন্ধকারের খোঁয়ারি তখনও কাটেনি,আমরা নেমে এসেছি সাগরের ধুসর বেলাভুমিতে।শির শিরানি হাওয়ায় কুয়াসা মোড়া পৌষের থিরথির করা পাতলা আলোয় অসংখ্য মানুষের মিলিত
পূণ্যস্নান।সমবেত কথোপকথন,শঙ্খ,শিঙা,খোল-করতালের বিচিত্র সুর ভাসছে বাতাসে।হাওয়ায় ওড়ে নারীর আলুলায়িত সিক্ত কেশরাশি।সাইকেলের পিছনে বাঁধা তুলসী গাছে স্নানন্তে পূজা।শ্রাদ্ধ-শান্তি-পিন্ড দান এমন কি তিলক কেটে গায়ে জামা,গলায় ফুলের মালা,পরে গরুও হাজির,যাতে ভক্ত গরুর ল্যাজ ধরে বৈতরণী পার হতে পারে।বিনিময়ে গরুর মালিকের প্রাপ্য কিছু দক্ষিণা।বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর চারিদিকে সজাগ দৃষ্টি।নজরদারি চলছে ড্রোন উড়িয়ে।নতুন এক জগতে,বিচিত্র যজ্ঞক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আমরা।ভক্তকুলের আকুতির মুর্ছনায় পূর্ব দিগন্তে রঙের ছোপ লেগেছে।দিন জাগছে,জেগে উঠেছে মেলাও।রাঙা আভায় প্লাবিত চরাচর।ছোটছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাড়ে,ফিরতি পথে ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে
পুণ্যার্থীদের দেওয়া পূজা সামগ্রী।স্থানীয় মানুষ সে সব জল থেকে তুলে চালান করে দিচ্ছে পাড়ে বসা ব্যাবসায়ীর কাছে,বিনিময়ে মিলছে পারিশ্রমিক।চোখের সামনে বিরামহীন বিভিন্ন চরিত্রের আনাগোনা‘নানা ভাষা .. নানা পরিধান’এ।প্রচুর ফটোগ্রাফার ফটো তুলছে বিশেষ মূহুর্তের।সে দলে কিছু গোরা সাহেব মেম ও আছে।হঠাৎ মোটা গলায় চিৎকার-‘এবার থামো দিকিনি বাপু,তীর্থেএসে সারাক্ষন শুধু কিচ-কিচ’।চোখ ঘুরিয়ে দেখি আষ্টেপিষ্টে কম্বল জড়ানো মাঝবয়সী পুরুষ দুহাতে দুই মহিলার হাত ধরে এগিয়ে আসছে।একজন হয়ত স্ত্রী,আরেকজন মা হবেন।বহুরূপী শিবের সাজে জলের কিনারা বরাবর হাঁটতে হাঁটতে সংগ্রহ করছে পূর্ণাথীদের দান।হঠাৎ হৈ-চৈ পরে গেল।কিছু মানুষ ভীষন তৎপর হয়ে
হাতে হাত লাগিয়ে রচনা করল মানব শৃঙ্খল।পুলিশ, চিত্র সাংবাদিকদের হুলুস্থুল।হয়ত কোন মন্ত্রী-সান্ত্রী মোক্ষলাভের জন্য সাঙ্গপাঙ্গো নিয়ে আসবেন।কৌতুহলী প্রশ্নে জানলাম আমার ভাবনা ভুল।পুরীর শঙ্করাচার্য স্বামী নিশ্চলানন্দ আসছেন স্নানে।কচি-কাঁচা ছাড়াও বহু মানুষ সমুদ্র স্নানের আনন্দে মশগুল।স্মার্ট ফোনে অনেকে তুলেছে সেলফি।শিশুকে আঁজলা করে জল তুলে স্নান করানো দেখে গায়ে পড়ে এক
আধুনিকা রা কাটলো‘কি অন্ধ বিশ্বাস!এই নোংরা-ঠান্ডা জলে,স্নান
করাতে হবে বাচ্চাটাকে?’ফাজলামির
করে রামকৃষ্ণদেবের কথা টুকে‘বিশ্বাসের চোখ আছে নাকি দিদি?’বলে পালালাম ওখান থেকে।মজা করা সোজা কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী অন্ধ
সংষ্কারের।দীর্ঘদিন সন্তানহীন স্ত্রী,মানত করত প্রথম সন্তান উৎসর্গ করবে গঙ্গা বা
এই সাগরের জলে।ভাবলে গা শিউরে ওঠে।ব্রিটিশ সাহেব মার্কুইস ওয়েলেসলি ১৮০১ সালে আইন
করে বন্ধ করে জঘন্যতম অপরাধ।
পাখ-পাখালী জাগার আগেই নেমেছি সাগর তটে।মাথায় রোদের তেজ,পেটে খিদের তেজ।তট ছেড়ে এগোলাম খাবার খোঁজে।গরম লুচির গন্ধে খিদেয় কাতর জিভের জল চুঁইয়ে ভিজিয়ে দেয় মুখ।লুচি, খোসা না ছাড়ানো আলুর তরকারী সঙ্গে চা খেয়ে তিনজনের হাঁটা বাসস্ট্যান্ডের দিকে। অনেকে কাঁখে, মাথায়,ঘাড়ে বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে বাসস্ট্যান্ড মুখো।মেলা ভাঙছে।সবার পায়ে-পায়ে ওঠা মেলার ধুলোয় তাদের জামা কাপড় ধুলামলিন।পোষাকের চাকচিক্যে পিছিয়ে থাকলেও প্রাণের ওজনের চমক ধরা পড়ে তাদের চোখের ভাষায় মুখের হাসিতে।কেউ কেউ ভিড় করে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কিনছে কাঁচের চুড়ি,চুলের ফিতে,নানা রঙের কপালের টিপ আরো অনেক সস্তা প্রসাধনী।বাসস্ট্যান্ডে ফিরতি মানুষের গিজগিজানি।বাসের এক কর্মী জানালেন খুব ভোর ভোর এলে আমাদের বসার আসন মিলবে।আবীরের কথায় আবার ফিরে এলাম সাগর তটে।জোয়ার এসে,ডাঙা হয়েছে ছোট। পূণ্যার্থী বেড়েছে।ভিড় ঠেলে কিছুটাএগিয়ে,রণে ভঙ্গ দিয়ে ফেরার পথ ধরা।খিচুড়ি আর মহোৎসবের প্রাণের গন্ধে ম ম করছে ভারত সেবাশ্রমের প্রান্তর।
আগামিকাল আমরা খুব ভোরে চেমাগুড়ি হয়ে নামখানা থেকে ট্রেন ধরব।ক্লান্ত,কেউ আর বেরোতে চাইল না।একা এসে দাঁড়ালাম বালুতটে।নিশ্চল মেঘে তারাদের মিটমিটে আলো।বাতাসের বেগে কাঁপন ধরানো শীতলতা।উছলে পড়া আনন্দ নিভে গিয়ে সঙ্গমতট শ্রান্ত অবসন্ন।কালো সাগরের জল জেগে উঠে বিষন্নতায় ভেঙে পড়ছে পাড়ে।স্তব্ধ মনে বাজে,বাপু হে সন্দেহ করে জেতার চেয়ে বিশ্বাসের কাছে হেরে দেখো না কেমন লাগে।খুব ধীরে নীরব অন্ধকারের অন্তরালে জলে নেমে প্রার্থনা করি –হে পরলোকের আত্মীয়-অনাত্মীয় সকলে আপনারা মুক্ত হোন।