২৩,অক্টোবর,২০১০,উপাসনা এক্সপ্রেসে চেপে বসলাম স্ত্রী-পুত্র কে নিয়ে, আপাতত গন্তব্য লক্ষ্ণৌ। পরদিন সকাল বেলা লক্ষ্ণৌ পৌঁছে বোঁচকা-বুঁচকি হোটেলে নামিয়ে,সামান্য জলযোগ,এবং তারপর পথে নামা। বড়া-ইমামবাড়া,ছোটা-ইমামবাড়া,চিড়িয়াখানা।
![]() |
বড়া-ইমামবাড়া |
অতঃপর দিবানিদ্রা। রাত্রি ৮-৩০ এ আয়েষবাগ ষ্টেশন থেকে ট্রেন। এবার গন্তব্য লালকূঁয়া। কূয়াসা মোড়া ছোট্ট ষ্টেশন লালকূঁয়া। ট্রেনের শব্দে মুখরিত সময় সকাল ৬-৩০। ষ্টেশনের বাইরে থেকে গাড়ী। হালদোয়ানী-কাঠগোদাম টপকে সবুজ পাহাড়ের বুক চেরা রাস্তা,ছোট জনপদ,দিগন্ত বিস্তৃত আলো-ছায়া পাহাড়ের তরঙ্গ,ফুরফুরে হিমেল বাতাস আর নীলাভ-সবুজ বর্ণছটা।প্রায় বেলা ২-৩০ নাগাদ বাগেশ্বর। মনের ইচ্ছে যদি প্রবল হয় তাহলে আপনি তা পাবেনই-এ কথা হলফ করে বলতে পারি এখন,কেন-তবে বিস্তারিত বলি। যাবার কথা ছিল গোমুখ-তপোবন,কিন্তু উত্তরাখণ্ডে প্লাবনের ভয়ংকর রূপ দেখে শুভাকাক্ষীরা ছাড়তে নারাজ। অথচ আমাদের হরিদ্বারের টিকিট ছাপা হয়ে গিয়েছে। হিমালয়ের প্রবল হাতছানি-কি করি! কিংকতর্ব্যবিমূঢ় অবস্থায় বন্ধু তাপসের কথায় বদল হল রাস্তা। গোমতী আর সরযু নদীর সঙ্গমে বাগেশ্বর উচ্চতা ৩১৯৮ফুট। কেদারনাথ মন্দিরের আদলে বাঘনাথবাগেশ্বর উচ্চতা ৩১৯৮ফুট।
কথিত,এক প্রস্থরখন্ডের ওপর মার্কণ্ডেয় মুনি ধ্যনস্থ।এদিকে গঙ্গা মা যে এই পথে নেমে আসবেন-কি করা যায়? মুনি কে সরাতে হবে এখান থেকে। অবশেষে দেবাদিদেব মহাদেবের লীলায় সৃষ্টি হল এক বাঘ,আর সেই বাঘ এর উৎপাতে ঋষির ভঙ্গ হল ধ্যান।কিন্তু, এতো যে সে ঋষি নয়। ঋষি সৃষ্টির মধ্যে পেলেন স্রষ্টার সন্ধান।বাঘ,এর মধ্যেই দর্শন করলেন মহাদেব কে। আর তীর্থ ভূমি পরিচিত হল বাঘেশ্বর অপভ্রংশে বাগেশ্বর। ১৫৫৭ সালে মহারাজা লক্ষীচন্দ্র ২৪ বছর রাজত্ব কালে বহু নতুন মন্দির এবং পুরানো মন্দিরকে নতুন করে নির্মান করেন। দুপুরের খাওয়া সাঙ্গ করে,নিজেদের সর্মাপন করলাম,আমাদের পথ-প্রদর্শক,খিলাপের হাতে। এরপর গাড়ী ধরে ২৫ কিমি দূরে ভারারী,
ভারারী থেকে সঙ্ বা সোয়াং,গাড়ী অবশ্য ৩কিমি দূরে লোহারখেত পর্যন্ত যায়। কিন্তু এবার তা হবার নয় প্রকৃতির রোষে রাস্তা লোপাট। অগত্যা হাঁটা। ছুঁই-ছুঁই সন্ধ্যায় পৌঁছালাম লোহারখেতে(৫৫০২ফুট) ।
সকাল বেলা লোহারখেতকে বিদায় জানিয়ে প্রায় ১২কিমি দূরে ঢাকুরী উদ্দেশে যাত্রা।মাথার উপর ঝকঝকে নীল আকাশ,একপাশে গভীর খাদ তবে রাস্তা বেশ চওড়া।চড়াই আর চড়াই,উতরাই খুব কম। পাথুরে রাস্তা কোথাও সঙ্কীর্ণ। রাস্তার দু-পাশে নবীন ও প্রাচীন গাছগাছালির আলো-ছায়া পথে রূপের খেলা। সঙ্গে হিমেল বাতাস,পাখির কলতান।খানিক জিরানো আবার হাঁটা।
লাঠিকে ভরসা করে নেমে এলাম ঢাকুরির সমতলে। আজকের মতো পথচলার ইতি। পূর্ত বিভাগের বিশ্রামাগারে রাত্রি-যাপন। খানিক নীচে কুমায়ুন মণ্ডলের বাংলো।
ইতস্তত তিন-চারটে টেন্ট,একপাশে ছোট চা এর দোকান। অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকার ছাওয়া আকাশ জুড়ে উজ্জ্বল রাতজাগা তারা। ঝিঁ-ঝিঁ পোকার বিরামহীন ডাক। কখনো কখনো, দূর থেকে ভেসে আসে রাতচরা পাখীর তীব্র তীক্ষ আওয়াজ। সামনের ঘনীভূত অন্ধকার ঠেলে চোখে ভেসে ওঠে পুজ্ঞিত হিমের শিখর। অপার্থিব সে দৃশ্য।
ঘুমভাঙানীয়া খিলাপের ডাকে উঠে পথ-চলার প্রস্তুতি। গন্তব্য ৯ কিমি দূরে
ইতস্তত তিন-চারটে টেন্ট,একপাশে ছোট চা এর দোকান। অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকার ছাওয়া আকাশ জুড়ে উজ্জ্বল রাতজাগা তারা। ঝিঁ-ঝিঁ পোকার বিরামহীন ডাক। কখনো কখনো, দূর থেকে ভেসে আসে রাতচরা পাখীর তীব্র তীক্ষ আওয়াজ। সামনের ঘনীভূত অন্ধকার ঠেলে চোখে ভেসে ওঠে পুজ্ঞিত হিমের শিখর। অপার্থিব সে দৃশ্য।
ঘুমভাঙানীয়া খিলাপের ডাকে উঠে পথ-চলার প্রস্তুতি। গন্তব্য ৯ কিমি দূরে
![]() |
ঘনীভূত অন্ধকার ঠেলে চোখে ভেসে ওঠে পুজ্ঞিত হিমের শিখর |
খাতি(৭৩৫৫ফুট)। বেশ আরাম দায়ক উতরাই। পাইন-ওক-রোডডেনড্রন আর নাম না জানা গাছ-গাছালির সবুজ সংসারে মায়াবী আলো-ছায়া বিছানো, আঁকা বাঁকা, এবড়ো-খেবড়ো পাথুরে রাস্তা ধরে তরতর করে এগিয়ে চলা। কিন্তু কথায় বলে –‘আরাম হারম হ্যায়’। এবার চড়াই, প্রানবায়ু বেড়িয়ে যাবার যোগাড়,ধপ করে কিছুক্ষন বসা –বিশ্রাম-আবার চলা।
পথচলা মানুষ,স্কুল-পড়ুয়া,শিশু-কিশোরদের নমস্তে-নমস্তে ধ্বনিতে সাড়া দিতে দিতে এগিয়ে যাওয়া,এ যেন সেই প্রাচীন আবরন মুক্ত ভারত। বেশ খানিক রাস্তা পেড়িয়ে একটা গ্রাম,বাড়ীর সামনের অংশে থাকবার ও খাবার দোকান,মুলত ট্রেকাররাই খদ্দের। একটা দোকান বসে চা ও ম্যাগী খেতে খেতে তাদের সঙ্গে আড্ডা।ইতিমধ্যে আকাশ জোড়া কালো মেঘে বৃষ্টি এল। কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় আমাদের জবুথবু অবস্থা দেখে দোকানের মালকিন এগিয়ে দিল কম্বল। আর এক প্রস্থ চা খেতে খেতে রোদ উঠল। সামনের পাহাড়ে তখন রামধনুর বর্ণছটা। খিলাপের তাড়াতে পথে নামলাম।
পথচলা মানুষ,স্কুল-পড়ুয়া,শিশু-কিশোরদের নমস্তে-নমস্তে ধ্বনিতে সাড়া দিতে দিতে এগিয়ে যাওয়া,এ যেন সেই প্রাচীন আবরন মুক্ত ভারত। বেশ খানিক রাস্তা পেড়িয়ে একটা গ্রাম,বাড়ীর সামনের অংশে থাকবার ও খাবার দোকান,মুলত ট্রেকাররাই খদ্দের। একটা দোকান বসে চা ও ম্যাগী খেতে খেতে তাদের সঙ্গে আড্ডা।ইতিমধ্যে আকাশ জোড়া কালো মেঘে বৃষ্টি এল। কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় আমাদের জবুথবু অবস্থা দেখে দোকানের মালকিন এগিয়ে দিল কম্বল। আর এক প্রস্থ চা খেতে খেতে রোদ উঠল। সামনের পাহাড়ে তখন রামধনুর বর্ণছটা। খিলাপের তাড়াতে পথে নামলাম।
![]() |
তারা সিং এর সঙ্গম কটেজ |
বন-চোঁয়া ভোরের আলোয় চার প্রাণীর এগিয়ে চলা। বিশ্বচরাচরে কোন এক অজানা শব্দের খোঁজে প্রত্যেকে তার নিজস্ব কায়দায় শব্দের সেতু তৈরী করে প্রকৃতির আরো গভীরে পৌঁছতে চাইছে। কখনো কখনো এক শব্দ নিভে গিয়ে তৈরী হচ্ছে নতুন শব্দ। অর্নিবচনীয় সেই শব্দ-শৃঙ্খলের মধ্যে দিয়ে হাঁটা। হিমেল বাতাসে অনাগরিক সুবাস। পায়ের নীচে নন্দাদেবী অভয়ারণ্যের শুকনো,নরম,বাদামী,হলুদ পাতার গালিচা। গাছের গভীর পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা পাখীদের কল-কাকলি আর অনেক নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া পিন্ডার গঙ্গার উচ্ছাস,শরীরের গভীরে থাকা মনকে গৃহত্যাগী করে তোলে।পথ চলার সেভাবে কষ্ট নেই। শুধু যেখানে যেখানে ধস নেমেছে সচ্ছন্দ গতি নষ্ট হছে।
![]() |
প্রকৃতির গভীরে
|
![]() |
নির্ভিক উচ্ছাস-উথলে এগিয়ে চলে পিন্ডার গঙ্গা
|
দুপুর ২-৩০ নাগাদ পৌঁছলাম দুয়ালী। কাফনী নালা আর পিন্ডার নদীর মিলনক্ষেত্র এই দুয়ালী। নদীর ওপর কাঠের সাঁকো পেড়িয়ে,অল্প চড়াই ভেঙে পৌঁছলাম আজকের আস্তানা কুমায়ুন মণ্ডলের বাংলোতে।
বিকেলে বাংলোর চারপাশে পায়চারী। চারিদিকে সবুজ পাহাড়ের তরঙ্গ,আশপাশের গাছগুলো অনেক ছোট, গুল্ম জাতীয়। উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের জীবন বৈচিত্রের যেমন বদল ঘটে প্রকৃতির বৈচিত্রেও সেই বদলও বিদ্যমান।
নদীর একঘেয়ে বয়ে চলার শব্দ ছাড়া চারিদিক অচঞ্চল-নীরব-নিস্পন্দ। দ্রুত স্তিমিত সূর্য আকাশে লালিমা ছড়িয়ে নদীর ওপারের পাহাড়ের পিছনে নেমে যায়। অন্ধকার ভারী হয়ে ওঠে। নিকষ কালোতে দৃশ্যমান পাহাড় হয়ে ওঠে প্রাচীন দৈত্যের মত। স্বচ্ছ আকাশ ছেয়ে অসংখ্য তারার চিক-মিক। রান্নাঘরে কাঠের আঁচে রাতের খাবার তৈরী হচ্ছে সঙ্গে বাংলোর কর্মচারীদের আড্ডা। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যোগ দিলাম আড্ডাতে,শুনলাম তাদের সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা,ভুত প্রেতের গল্প আর জন্তু-জানোয়ার,বিশেষতঃ ভাল্লুকের আক্রমণ ও তা থেকে বাঁচার ইতিবৃত্ত।
আজ যাব ফুরকিয়া(১০৪৬৫ফুট)। ৭কিমি রাস্তা। খুব সকাল সকাল বেরিয়েছি সবাই। পথ ভীষন চড়াই। সকালের হিম-তীক্ষ প্রবল বাতাস আছড়ে পড়ছে চোখ- মুখের ওপর। অবসন্ন,ক্লান্ত পা কোনরকমে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। মাঝে মাঝে দাড়াচ্ছি,গামছায় ঠান্ডা ঘাম মুছে,জল খেয়ে আবার হাঁটছি। উজ্বল ইস্পাত নীল আকাশ। চারিদিক শুকনো বিবর্ণ সবুজ। নিঃসীম নীরবতায় ভরাট এই অঞ্চলে নিজের পায়ের শব্দে নিজেকেই চমকে উঠতে হয়। খাড়া উঁচু চড়াই দেখে বড় একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে,সঙ্গীদের এগিয়ে যেতে বলে,বসে পড়লাম। এ যেন ভাষাহীন-বৈচিত্রহীন-নীরব-নিশ্চল এক অরন্য। দীর্ঘক্ষন বসে থাকার জন্য শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে,স্যাক থেকে উইন্ড-চিটার বার করে পড়ে নিলাম। গত রাতে শোনা ভাল্লুকের গল্পটা মনে পড়তে একদমে টানা চড়াই ভেঙে উঠে পড়লাম। কিন্তু নীচ থেকে যা দেখেছি,ওখান পৌঁছে দেখি,আর একটা খাড়া চড়াই উঠতে হবে আমায়। মনের ভিতর ভয়টা ভয়ঙ্কর জমাট। বুক অজানা ভয়ে কাঁপছে-কি কুক্ষনে যে আমি সবাই কে চলে যেতে বললাম!এখন যদি রাস্তা হারাই! হাঁটার বেগে কামারশালার হাঁপড়ের মত শ্বাসের আওয়াজ। ‘দাদা ইধার’,খিলাপের গলা। নিজের অসহায়তা লুকিয়ে উত্তর দিলাম,‘হ্যাঁ যাচ্ছি’।' সাড়ে তিন কিমি যানেসে ফুরকিয়া,আভি থোড়া রেষ্ট কিযিয়ে,দাদা’। পকেট থেকে চকোলেট বার করে সবাইকে দিলাম।
পথ এখন অনেক সরল। সে ভাবে চড়াই-উতড়াই নেই,হাল্কা চালে গল্প-গুজব করতে করতে হাঁটা। বেলা দেড়টা-দুটো নাগাদ পৌঁছে গেলাম ফুরকিয়ায় কুমায়ুন মণ্ডলের বাংলোতে। হাত বাড়ালেই সাদা পাহাড়। ঘরে বোঁচকা-বুঁচকি নামিয়ে,বাইরে চেয়ারে বসে সূর্যের গরম ওম নিতে নিতে তাকিয়ে থাকি উদ্ধত হিম-শিখরের দিকে। মাথার ওপর রোদে পোড়া নীল আকাশ,সামনে গগনর্স্পশী হিমগিরির ওপার থেকে ভাষাহীন-শব্দহীন এক অসীম নির্জনতার আশ্বাস ভরা হাতছানি। অন্তহীন আনন্দ ও নিবিড় শান্তিতে শিশুর মত ছল-ছল করে ওঠে চোখ। খাবার ডাক আসে। আনমনে এগিয়ে চলি রান্নাঘরের দিকে। গরম ভাতের গন্ধে চনচনে খিদের অনুভুতি। আলুসিদ্ধ-ডাল-ডিমসিদ্ধ আর ঘি সহযোগে গরম ভাত।এ যেন অমৃতের আস্বাদ। খাওয়া শেষ করে চেয়ারে এসে বসলাম আবার। চারিদিকের পরিবেশের প্রভাবে মন শান্ত-নিস্তরঙ্গ-উচ্ছ্বাসহীন। চরাচর যখন হাল্কা নীলাভ,গুটি গুটি পায়ে,শীতে কাঁপতে কাঁপতে,ভোরের আলোর খোঁজে
ক্যামেরা হাতে এগিয়ে যাচ্ছি। অপ্রস্তুত কোন পাখী সোনালী ঘাসের ঝোপ থেকে ডানার ঝাপটা দিয়ে জানান দিল আমি একা নই। সে ও এই তরল অন্ধকার কখন ঝরে পড়বে তার জন্য অপেক্ষারত। হিমশিখরে আবছা লাল,ক্রমশ ঘন লাল-কমলা-সোনালীর রঙের নৃত্য। এই মোহময়ী রূপের বর্ণনা দিতে অক্ষম আমি খন্ডিত মূহুর্তকে বন্দী করলাম ক্যামেরাতে।যদিও বাড়ি ফিরে হাতকাঁপা ছবিগুলো দেখে নিজের প্রতি করুণা হয়েছিল। বাংলোতে ফিরে বেরিয়ে পড়লাম
৫ কিমি দূরে পিন্ডার গঙ্গা উৎসের সন্ধানে। বুগিয়ালের ওপর দিয়ে কুয়াশার চাদর সরিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলা।
![]() |
নবজাতক পিন্ডার গঙ্গা |
![]() |
স্বামী ধর্মানন্দ গিরি মহারাজের ডেরা |
‘মরণ আঁধার কোলে,জীবন আলোকে জ্বলে
শংকর শিব সাজে সাজিয়া দয়াল।
মাভৈঃ! মাভৈঃ! মাভৈঃ! মাভৈঃ!’
এবার ফেরার পালা,ফুরকিয়াতে মধ্যাহ্ন ভোজন করে বেরিয়ে পড়া দুয়ালীর উদ্দেশে। একই পথ শুধু উৎরাইয়ে দ্রুত নেমে যাওয়া কোনো দিকে তাকানোর ফুসরত নেই। দিনের আলো থাকতে থাকতে পৌঁছতে হবে গন্তব্যে।
মেঘলা আকাশ,কম্বল ছেড়ে বেরোলেই তীরের মত বিঁধছে ঠান্ডা। ঘড়িতে তখন সকাল নটা,যেতে হবে খাটিয়া,দূরত্ব ৭ কিমি। খিলাপ জানাল,ডাল-ভাত খেয়ে ১২ টা নাগাদ বেরনো হবে। হাতে এখন অনেক সময়। কম্বল মুড়ি দিয়ে গেলাম সোজা রান্নাঘরে উনুনের পাশে। কাঠের জ্বালে হাঁড়িতে চা ফুটছে। গরম গরম চা খেয়ে বাইরে চেয়ারে এসে বসি। বাংলোর পিছনে মেষপালকদের একটা দল আশ্রয় নিয়েছে,তাদের কুকুরের চীৎকার নদীর গর্জন ছাড়া চারিদিক নিস্তব্ধ-নিঝুম।এমন কি পাহাড়-গুলো ঘুমে অসাড়। স্নানের জন্য গরম জল দিয়ে গেল,অগত্যা ধড়াচূড়া ফেলে স্নানাগারে।
খাওয়া-দাওয়া পর্ব শেষ হতে আমাদের আশ্চর্য করে সূর্যদেব মিট মিট করে চোখ খুললেন। জেগে উঠল পাহাড়,আলোর বন্যায় চিক চিক করছে চারদিক। আমরা দুয়ালীকে বিদায় জানিয়ে কাফনী নালার পাশ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। পিন্ডারীর রাস্তার থেকে এ রাস্তা একটু বিপদজনক। একপাশে গভীর খাদ। নীচ দিয়ে বয়ে চলা খরস্রোতা কাফনী নালা। তবে বাঁকে বাঁকে অপার সৌন্দর্য। ঝরা পাতার নানা রঙে চিত্রিত কার্পেট বিছানো পথ।
দু-তিনটে ছোট ধস পেরোনো ছাড়া সে ভাবে কোন অসুবিধা নেই। পাহাড়ের সর্পিল পথের পাথরের ফাঁকে ফাঁকে হলুদ-বেগুনী-সাদা ছোট ছোট ফুটে থাকা বনজ ফুল। খিলাপ,ভূর্জপত্রের গাছ থেকে পাতলা-কাগজের মত বাকল,সজারুর পড়ে থাকা কাঁটা হাতে তুলে দিল। পিণ্ডারির থেকে এ রাস্তা অনেক বন্য। ধীর গতিতে লাঠির সাহায্যে উতরাই নামচি, যাতে শুকনো পাতায় পা না হড়কায়। গভীর উতরাই ভেঙে যেখানে এসে পৌঁছালাম,সেখান থেকে চড়াই এ উঠতে হবে। পথের কোন নিশানা নেই। পড়ে আছে পথের ধবংশাবসেস। বিভিন্ন আকারের বোল্ডার। মোটামুটি চার হাত পায়ে স্ত্রীর প্রবল বাক্যবানে বিদ্ধ হতে হতে খিলাপের সাহায্যে এক অন্ধ শক্তি ও প্রবল তাড়নায় সবাই পেরিয়ে গেলাম। উচ্ছ্বাস ও আনন্দে ভরা মনে প্রত্যেকের সতেজতা।
খানিক বিশ্রাম নিয়ে হাঁটা শুরু। খামখেয়ালী চড়াই বা উতরাই সেভাবে নেই।পথের দুপাশে থোকা থোকা ছোট ছোট লাল ফল,অনেক টা কুঁচ ফলের মত।খিলাপ কিছু ফল ছিঁড়ে আমাদের দিল,নিজেও মুখে পুরল। ‘দাদা খা লিজিয়ে,এ গাঙুর,আচ্ছা লাগেগা’। কিন্তু কিন্তু করে সবাই মুখে পুরলাম।টক-টক,মিষ্টি-মিষ্টি এই ফল ছেঁড়া আর খাওয়ার নেশায় সবাই মেতে উঠলাম। পথে এক মেষ পালকের সঙ্গে দেখা,হাসি বিনিময়, খিলাপ আমাদের এগিয়ে যেতে বলে,তার সঙ্গে গল্পে মেতে উঠল।
দু-তিনটে ছোট ধস পেরোনো ছাড়া সে ভাবে কোন অসুবিধা নেই। পাহাড়ের সর্পিল পথের পাথরের ফাঁকে ফাঁকে হলুদ-বেগুনী-সাদা ছোট ছোট ফুটে থাকা বনজ ফুল। খিলাপ,ভূর্জপত্রের গাছ থেকে পাতলা-কাগজের মত বাকল,সজারুর পড়ে থাকা কাঁটা হাতে তুলে দিল। পিণ্ডারির থেকে এ রাস্তা অনেক বন্য। ধীর গতিতে লাঠির সাহায্যে উতরাই নামচি, যাতে শুকনো পাতায় পা না হড়কায়। গভীর উতরাই ভেঙে যেখানে এসে পৌঁছালাম,সেখান থেকে চড়াই এ উঠতে হবে। পথের কোন নিশানা নেই। পড়ে আছে পথের ধবংশাবসেস। বিভিন্ন আকারের বোল্ডার। মোটামুটি চার হাত পায়ে স্ত্রীর প্রবল বাক্যবানে বিদ্ধ হতে হতে খিলাপের সাহায্যে এক অন্ধ শক্তি ও প্রবল তাড়নায় সবাই পেরিয়ে গেলাম। উচ্ছ্বাস ও আনন্দে ভরা মনে প্রত্যেকের সতেজতা।
![]() |
পথের ধবংশাবসেস |
![]() |
খাতিয়ার জেলা-পঞ্চায়েত অতিথি-নিবাসে |
আমরাও হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম আজকের আস্তানা,খাতিয়ার জেলা-পঞ্চায়েত অতিথি-নিবাসে। যতদুর মনে পড়ছে চৌকিদারের নাম
প্রদীপ। আমাদের দেখে হাসি মুখে এগিয়ে আসে,‘আপনারা কি খিলাপের অতিথি?' খিলাপের পাকা ব্যবস্থাপনা।দুয়ালী থেকে সকালে এক মেষপালককে দিয়ে আমরা যে এখানে আসছি,সে খবর পাঠিয়েছে। বোঁচকা বুঁচকি নামিয়ে,রেজিষ্টারে নাম লেখা ইত্যাদি করতে করতে খিলাপ ও চা এসে গেল। পশ্চিমে রঙের খেলা। খিলাপের প্রশ্ন- ভেড়ার মাংস কি আমরা খাব? সম্মতি পেয়ে চা খেয়ে সে বেরিয়ে পড়ল। দূরের পাহাড়ের পিছনে সূর্য নামতে ধীরে ধীরে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হিম-অন্ধকার নেমে আসে। পরিষ্কার আকাশে ঝাঁক ঝাঁক তারার জ্যোতি। শীতের তীব্রতায় ছুট লাগালাম উষ্ণতার জন্য রান্নাঘরে। প্রদীপের সঙ্গে গল্প-গুজবের মধ্যে খিলাপ এল একটা পচা গন্ধ নিয়ে। কিসের গন্ধ? খিলাপ সঙ্কোচের সঙ্গে জানাল-ভেড়ার মাংসের। ঝাঁঝাল পচা গন্ধে প্রান ওষ্ঠাগত। দূরে কোথাও মাংস স্থানান্তরিত হবার পর শুনলাম-এই ভেড়াটাকে বাঘে মেরেছে তিনদিন আগে। মাংস খাওয়া সঙ্গে সঙ্গে বাতিল হল ঠিকই কিন্তু মনের ভিতর গোপন বাঘের ভয় চেপে বসল। খিলাপের থেকে জানলাম তারা মাংসকে শুকিয়ে রেখে দেয় শীতের খোরাকি হিসাবে।
বাংলোতে কোন আলোর ব্যবস্থা নেই। কুমায়ুন মণ্ডলের বাংলোতে সোলার লন্ঠনের ব্যবস্থা ছিল। এখানে মোমবাতি ও নেই। অগত্যা টর্চ জ্বেলে বিছানা ঠিক হল। আলো নিভতেই ঘন কাজলের মত অন্ধকার। অজানা আতঙ্কে,নিশ্চিন্ত ঘুমের ইচ্ছাকে সবলে অসাড় করে দিয়েছে বাঘের ভয়। গুটিসুটি মেরে বিছানায় পড়ে থাকা আর ভোরের আলোর জন্য নিরন্তর ব্যকুলতা।
বাংলোর দরজা যখন খুললাম আলোয় ভাসছে খাতিয়া। ঝটপট প্রস্তুত হয়ে বেড়িয়ে পরা স্নাউট পয়েন্টের উদ্দ্যেশে।কুয়াশার ঠান্ডা স্পর্শে গত রাতের ক্লেশ-ক্লান্তি ধুয়ে মুছে সাফ। চিরন্তন নীরবতা,অন্থহীন অস্ফুটতাকে আলিঙ্গন করে বুগিয়ালের ওপর দিয়ে হাঁটা মাঝে বোল্ডারকীর্ণ এলাকা টপকে অবশেষে নদীর আঁতুড় ঘরে। এত কাছ থেকে গ্লেসিয়ার এর আগে দেখিনি। একদিকে শ্বেতশুভ্র তুষারের সাদা ঢেউয়ে ঢাকা নন্দাভানা আর এক দিকে নন্দাকোট। গহনে অবিরত ভাঙনের ঝনৎকার। মাথার ওপর পাখীর বুকের মত নরম সাদা শরতের ভেসে যাওয়া মেঘ। পায়ের নীচে তির তির করে বয়ে চলা কাফনী নালা। ঝাঁপিয়ে-পড়া,তলিয়ে-যাওয়া,গড়িয়ে-চলার কোন হাঁকডাক নেই কাফনীর বরং শিশুর মত হামা দিয়ে এগিয়ে যায় নির্দিষ্ট যৌবনের দিকে।
![]() |
তির তির করে বয়ে চলা কাফনী নালা |
রাতের আকাশের নীচে গোল করে বসে গল্প-গুজব। হিম-ধোয়া বাতাস এখন আর কাঁপন ধরায় না বরং বোধে জেগে ওঠে নির্মল, সুস্নিগ্ধ মায়ের পরশ। পাহাড় টপকে ওপারে কিছু পথ এগোলে বিপুল জনস্রোতের মধ্যে আবার ছুট,আবার আলো,ধুলো,জনকোলাহল,যন্ত্রের ঝনৎকার। ফুসরত নেই অলস ভাবে দম নেবার। নিঃশব্দে ভেসে যাবার ইচ্ছা বন্দী থাকে লোহার খাঁচাতে। গত কয়েকদিন পিন্ডারী আর কাফনীর কোলে কোলে অপরিচয়ের বিপুল উদারতায় ভুলে ছিলাম সব। দুচোখ ভরা অবাক বিস্ময়,দুকান ভরা মূর্চ্ছনায় মনের দু-কুল ছিল ভরে। আজ এই নবমীর নিশি কোথা থেকে একরাশ বিষাদ ঢেলে দেয়।
'হে প্রকৃতি এই নামহীন পথিকের প্রনাম গ্রহণ কর।'
'হে প্রকৃতি এই নামহীন পথিকের প্রনাম গ্রহণ কর।'